‘নকল রোধে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ’
সাক্ষাৎকারে ড. মো. নজরুল আনোয়ার, মহাপরিচালক, বিএসটিআই
নকল পণ্য নীরব ঘাতক, যা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব। নকল পণ্য প্রতিরোধে কথা বলেছেন বিএসটিআই মহাপরিচালক ড. মো. নজরুল আনোয়ারঃ
*নকল পণ্য বন্ধ করতে বিএসটিআইর কার্যক্রম জানতে চাই। আর কী কী করা উচিত?
নজরুল আনোয়ার :শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএসটিআই দেশের একমাত্র মান সংস্থা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতীয় মান সংস্থার যাত্রা হয়, যা ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক মান সংস্থা আইএসওর সদস্যপদ লাভ করে। সরকার বিভিন্ন সময়ে এসআরও জারির মাধ্যমে এ যাবৎ ১৮৪টি পণ্য বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স ছাড়া বিক্রি ও বিতরণ নিষিদ্ধ করেছে। এসব পণ্য বিএসটিআইর ল্যাবে পরীক্ষা করে সিএম লাইসেন্স (মান সনদ) দেওয়া হয়। মান সনদ দেওয়ার পাশাপাশি নকল ও লাইসেন্সবিহীন পণ্য উৎপাদন, বিক্রয় ও বিতরণ প্রতিরোধে বিএসটিআই সারাদেশে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট ও সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। করোনাকালীন মোবাইল কোর্ট ও সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ২২১টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এ সময়ে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা জরিমানা, ১৭টি কারখানা সিলগালা ও ২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদানসহ প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের অবৈধ ও নকল পণ্য জব্দ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং স্পটে ধ্বংস করা হয়। একই সময়ে ৪৬৮টি সার্ভিল্যান্স টিম পরিচালনা করে ৫৪টি অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নকল ও ভেজাল পণ্য বাজারজাত বন্ধে সরকার বদ্ধপরিকর। বিএসটিআইর পাশাপাশি নকল ও ভেজাল পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ রোধে উৎপাদনকারী, ভোক্তা ও মিডিয়াসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বিএসটিআইর আওতাবহির্ভূত অনেক ভোগ্যপণ্য রয়েছে। এগুলোর নকল ও ভেজাল
প্রতিরোধে সরকারের আরও দুটি সংস্থা যথা : জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। সরকারের এসব প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ কর্মপরিধি অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনাসহ ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মিডিয়াতে প্রচারণা অব্যাহত থাকলে নকল ও ভেজাল পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ কমতে পারে।
*নকল পণ্য রোধে সমকালের প্রচারাভিযানের এ উদ্যোগ কীভাবে দেখছেন?
নজরুল আনোয়ার : নকল ও ভেজাল পণ্যের উৎপাদন,বাজারজাতকরণ ও বিক্রি বন্ধে দৈনিক সমকাল পত্রিকার নিয়মিত প্রচার কার্যক্রমের জন্য বিএসটিআইর পক্ষ হতে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বিএসটিআই নকল ও ভেজাল পণ্যের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রি বন্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। উক্ত অভিযানকালে সমকালের প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে সচিত্র তথ্য সংগ্রহ করে প্রচারের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে পারেন।
সমকাল : নকল বন্ধে বিভিন্ন সংস্থার পদক্ষেপ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? একক বা যৌথভাবে নতুন পদক্ষেপ কী হতে পারে?
নজরুল আনোয়ার : নকল ও ভেজাল প্রতিরোধে সংশ্নিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত উদ্যোগ ও কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন ও পরিধি ভিন্ন। কাজেই সব প্রতিষ্ঠান স্ব স্ব অবস্থান থেকে নকল ও ভেজাল বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
*নকল পণ্য রোধে কিউআর কোড যাচাই করার উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই?
নজরুল আনোয়ার : বিএসটিআইর লাইসেন্স পাওয়া পণ্যের নকল প্রতিরোধে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনলাইন বেইজড লাইসেন্স ইস্যুসহ কিউআর কোড প্রবর্তনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ভোক্তারা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সহজেই পণ্যের বিএসটিআইর লাইসেন্স সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাবেন। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
*নকল রোধে আইন ও নীতিমালা রয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে আইনের কোন কোন বিষয়ে সংশোধন প্রয়োজন?
নজরুল আনোয়ার : বিএসটিআই অধ্যাদেশ-১৯৮৫ রহিত করে বিএসটিআই আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের অধীন বিএসটিআই প্রবিধানমালা-১৯৮৯ সংশোধনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ‘দি স্ট্যান্ডার্ডস অব ওয়েটস অ্যান্ড মেজার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮২’-কে রহিত করে ‘ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন-২০১৮’ প্রণীত হয়েছে। এ আইনের অধীনে ‘বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ওজন এবং পরিমাপ (পণ্য সামগ্রী মোড়কজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৭ সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সময়ের প্রয়োজনে এ আইন ও বিধিমালা/প্রবিধানমালায় বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাশাপাশি নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত রোধে অপরাধের শাস্তি বাড়ানো হয়েছে।
*ক্রেতাদের সচেতনতা বাড়াতে আপনার পরামর্শ কী?
নজরুল আনোয়ার : বিএসটিআইর উদ্যোগে প্রতিবছর উৎপাদনকারী, ভোক্তা ও সংশ্নিষ্ট সবার সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ‘বিশ্ব মান দিবস’ ও ‘বিশ্ব মেট্রোলজি দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়মিত সভা ও গণশুনানির মাধ্যমে মতবিনিময় করা হচ্ছে। সভায় স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়া বিএসটিআইর ওয়েবসাইটে বিভিন্ন বিষয়ে ফোকাল পয়েন্ট/কর্মকর্তাদের নাম, টেলিফোন নম্বরসহ তথ্য রয়েছে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার থেকে সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী সেবা গ্রহণের বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হয়। গ্রাহকরা এসব মাধ্যম ব্যবহার করে নকল ও ভেজাল পণ্য সম্পর্কে বিএসটিআই সম্পর্কে অবহিত করতে পারে। কোনো পণ্যের লাইসেন্স সম্পর্কে সন্দেহ হলে তাৎক্ষণিকভাবে বিএসটিআইর ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তার সঙ্গে অথবা বিএসটিআইর হট লাইনে (১৬১১৯) নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।
*পণ্যের মান নিশ্চিত করতে বিএসটিআইর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন?
নজরুল আনোয়ার : পণ্যের মান নিশ্চিত করতে বিএসটিআই ইতোমধ্যে নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে ৪৩টি পণ্য বাধ্যতামূলক সিএম লাইসেন্সের আওতাভুক্তকরণ, কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ, প্রধান কার্যালয় ও বিভাগীয় কার্যালয়ে রসায়ন পরীক্ষণ ল্যাব, পদার্থ পরীক্ষণ ল্যাব ও ন্যাশনাল মেট্রোলজি ল্যাব (এনএমএল) স্থাপন ও সম্প্রসারণ, ১৩টি বিএসটিআই আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন এবং ৪৩টি জেলা কার্যালয় স্থাপন উল্লেখযোগ্য। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে পণ্যের মান পরীক্ষাসহ মান সনদ প্রদান এবং নকল ও ভেজাল পণ্য প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট ও সার্ভিলেন্স কার্যক্রম সম্প্রসারিত হবে।