যৌথ বাহিনীর অভিযান আরও জোরদার হচ্ছে

রোজা ও ঈদের কেনাকাটা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে পেশাদার ও মৌসুমি অপরাধীরা। জাল টাকার কারবার, ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি, অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির কিছু তৎপরতা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থায় রমজান মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অভিযানের নাম ‘ডেভিল হান্ট’ আর থাকছে না বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

রমজান মাসে বিশেষ কিছু অপরাধ বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এমন আশঙ্কা সামনে রেখে সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রস্তুতি জোরদার করতে বলা হয়েছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা নতুনভাবে সাজিয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রবিবার (২ মার্চ) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কোর কমিটির সভা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য চলমান বিশেষ অভিযান রমজান মাসে আরও জোরদার করা হবে। মহাসড়কে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি ঠেকাতে এবং ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলনের সময় ডাকাতি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বৈঠকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে বলা হয়, অপরাধ দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলবে, তবে অপারেশন ডেভিল হান্ট নাম থাকবে না। বিশেষ অভিযানে যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে, কোর কমিটির বৈঠকে এ বিষয় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নাম নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়সহ অনেকেই এই নাম পছন্দ করছেন না বলে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এমন অবস্থায় অপরাধ দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযান আরও জোরদার করা হলেও ডেভিল হান্ট নামটি আর ব্যবহার করা হবে না বলে জানা গেছে।

বৈঠকের এই সিদ্ধান্তের পর গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানানো হয়নি। যদিও ৮ ফেব্রুয়ারি এ অভিযান শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই আলাদাভাবে অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের খবর জানানো হতো।

সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য চলমান বিশেষ অভিযান রমজান মাসে আরও জোরদার করা হবে। মহাসড়কে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি ঠেকাতে এবং ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলনের সময় ডাকাতি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

রমজানে অপরাধ বৃদ্ধির শঙ্কা: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, রোজা ও ঈদের কেনাকাটা ঘিরে রমজান মাসে মানুষের তৎপরতা বাড়ে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বাড়ে লেনদেন। গভীর রাত পর্যন্ত বিপণিবিতানকেন্দ্রিক জনসমাগমও বেড়ে যায়। তারাবিহর নামাজ ও সাহ্‌রি ঘিরেও পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে সর্বত্র রাতের বেলায় মানুষের উপস্থিতি থাকে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাপক জনসমাগমের সুযোগটিই কাজে লাগায় অপরাধীরা। ব্যক্তিগত গাড়ি ও যানবাহন রেখে মালিক দীর্ঘক্ষণ দূরে থাকলে সেগুলো অপরাধীদের চুরির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ব্যক্তির সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং লেনদেনে জাল নোট চালিয়ে দিতে তৎপর হয় অপরাধীরা। এ জন্য সব সময় রমজানে জাল নোটবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

পুলিশ ও র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রমজানে ‘টানা পার্টির’ দৌরাত্ম্য বাড়ে। বিপণিবিতানে যাওয়া মানুষ ছিনতাই ও ডাকাতির লক্ষ্যবস্তু হন। গাড়ি চুরির সংঘবদ্ধ চক্রগুলোও এ সময় সক্রিয় হতে থাকে। এই ঘটনাগুলো ইফতারির বাজার, বিপণিবিতান, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট ঘিরে বেশি ঘটে। এ জন্য জনসমাগম বেশি এমন এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বলেন, সব সময় রমজান ঘিরে টানা পার্টি, ছিনতাইকারী চক্র, জাল টাকার কারবারিসহ সুনির্দিষ্ট কিছু অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সারা দেশে র‌্যাবের ২০০–এর মতো টহল দল কাজ করছে। এদের পাশাপাশি সাদাপোশাকে র‌্যাব সদস্যরা বিপণিবিতান, ইফতারির বাজার ও জনসমাগম বেশি এমন এলাকাগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন।

ব্যক্তির সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং লেনদেনে জাল নোট চালিয়ে দিতে তৎপর হয় অপরাধীরা। এ জন্য সব সময় রমজানে জাল নোটবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাড়তি নজরদারি: ঈদুল ফিতর সামনে রেখে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির (বিএসওএ) এক জরিপে উঠে এসেছে। মূলত রমজান মাস ঘিরে সক্রিয় অপরাধী চক্রের অন্যতম লক্ষ্য থাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ছিনতাই ও ডাকাতি। অর্থ পরিবহন এবং অর্থ লেনদেনের সময় এসব ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা নিতে ইতিমধ্যে আহ্বান জানানো হয়েছে। তা ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বিশেষ নজরদারি করতে পুলিশের নির্দেশনা রয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) ইনামুল হক সাগর বলেন, অপরাধ দমনে সারা দেশে বিশেষ অভিযান চলছে। রমজান ঘিরে অপরাধ মোকাবিলায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন পুলিশের পাঁচ শতাধিক টহল দল বের হচ্ছে। নগদ অর্থ উত্তোলন ও পরিবহনে রাজধানীতে ‘মানি এসকর্ট’ সেবা দিচ্ছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

সব সময় রমজান ঘিরে টানা পার্টি, ছিনতাইকারী চক্র, জাল টাকার কারবারিসহ সুনির্দিষ্ট কিছু অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সারা দেশে র‌্যাবের ২০০–এর মতো টহল দল কাজ করছে। এদের পাশাপাশি সাদাপোশাকে র‌্যাব সদস্যরা বিপণিবিতান, ইফতারির বাজার ও জনসমাগম বেশি এমন এলাকাগুলোতে দায়িত্ব পালন করছে।

রমজান মাস শুরুর প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫৭৫টি টহল দল রাজধানীতে নিয়োজিত ছিল বলে জানিয়েছে ডিএমপি। ৬৫টি তল্লাশিচৌকি পরিচালনা করা হয়েছে এ সময়। বিভিন্ন অপরাধে ঢাকায় ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ জন ডাকাত, ১৮ জন পেশাদার ছিনতাইকারী, ৪ জন চাঁদাবাজ, ১০ জন চোর বলে জানিয়েছে ডিএমপি।

ডিএমপির উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ডিএমপিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশগ্রহণে সমন্বিত তল্লাশিচৌকি ও টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ডিএমপির ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ডিএমপির টহল টিমের পাশাপাশি মহানগরীর বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ স্থানে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলো কাজ করছে। এ ধরনের কার্যক্রম সারা মাস চলবে।

কোর কমিটির একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত: এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটপ্রধান, উপপুলিশ কমিশনার, সেনাবাহিনীর মাঠে নিয়োজিত ব্রিগেডপ্রধান ও অন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রতিটি ঘটনার বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানাবেন। মিথ্যা, গুজব ও অপপ্রচারের বিপরীতে সত্য তথ্য প্রচারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে সরকার।

থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে কোর কমিটির সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডিএমপির পুলিশ সদস্য, বিজিবি, আনসার ও কোস্টগার্ডের সদস্যদের জন্য মোটরসাইকেল কেনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; যাতে তাৎক্ষণিকভাবে অলিগলি টহল দিয়ে অপরাধীদের ধরা সম্ভব হয়। ছিনতাইকারী, ডাকাত, কিশোর গ্যাং ও অপরাধপ্রবণ অন্য স্থানগুলোতে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

সভায় আরও জানানো হয়, মামলা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তকরণে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মামলা মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে ঝটিকা পরিদর্শনে যাবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

জুলাই বিপ্লবের শহীদ পরিবারের মামলাগুলো নিয়মিতভাবে গুরুত্বের সঙ্গে তদারকি করা হচ্ছে; যাতে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্তপূর্বক আইনের আওতায় নিয়ে আসা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তল্লাশিচৌকি ও অপরাধপ্রবণ এলাকায় টহল সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী নির্দিষ্ট এলাকাসমূহে জোরদার অপারেশন পরিচালনা করছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সদস্যদের অতিরিক্ত টহলে নিয়োজিত করা হয়েছে। ঢাকা শহরের আশপাশে বিশেষ করে টঙ্গী, বছিলা, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে।

 

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.