মনিরা মিতা’র ছোট গল্প ‘কৃতদাস’
হিমহিম ঠান্ডায় জমে গেছে চারিপাশ। শৈত্য প্রবাহ বইছে গত তিনদিন ধরে। এই ঠান্ডায় পুকুর থেকে পানি তুলছে ছোট্ট হীরা। ওর কঁচি হাতদুটো ঠান্ডায় নীল হয়ে গেছে। হীরা তবুও পানি তুলছে কারন তার মা খুব অসুস্থ। আজ মায়ের কাজ তাকে করতে হবে।
মরিয়ম বেগম মানে হীরার মা ঘরের কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। গায়ে শীতের ছেঁড়া পোশাকগুলো জড়ানো। গত দুই মাস থেকে তার শরীরটা খারাপ। প্রায়ই জ্বর আসে। কাশতে কাশতে দমবন্ধ হয়ে যায়।
মরিয়ম আর হীরা প্রায় নয় মাস আগে এই ইটভাটায় এসেছে কাজের জন্য।
ওদের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। উত্তর আর দক্ষিনের ব্যাবধান অনেক। কোথায় কুড়িগ্রাম আর কোথায় সাতক্ষীরা! এতোদূর মরিয়ম পাড়ি জমিয়েছে তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে। গ্রামে রেখে এসেছে তার আদরের হিরু আর নুরুকে।
স্বামী, দুই ছলে আর এক মেয়ে নিয়ে বেশ ভালোই ছিলো মরিয়ম। হঠাৎ মরিয়মের সব সুখ কালবৈশাখীর দমকা হাওয়ায় চুরমার হয়ে গেল।
দিনমুজুর ছিল তার স্বামী। যখন যে কাজ পেত তখন সেটাই করতো। এক সকালে কাজের খোঁজে বের হলো আর সন্ধ্যায় লাশ হয়ে ফিরলো।
সিটি কর্পোরেশনের কাজ পেয়েছিল সে, নর্দমা পরিস্কারের কাজ। নর্দমা পরিস্কার করতে ম্যানহোলে নামতে হয়েছিলো তাকে। নামতে চায়নি সে, কিন্তু কর্মকর্তাদের এক কথা- ”কাজ নিয়েছ, সুতরাং কাজ শেষ করতে হবে।”
বাধ্য হয়ে দিনমুজুর হারুনকে নামতে হলো ম্যানহোলে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কিন্তু হারুন আর ওঠে না ম্যানহোল থেকে। সন্ধ্যায় ম্যনহোলের ভেতর থেকে বের করে আনা হলো হারুনকে। ডাক্তার বললো ম্যানহোলের ভেতরে জমে থাকা গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে হারুন।
হারুনের মৃত্যুতে কারো কিছু গেল-এলো না। শুধু তিন সন্তান নিয়ে পথে এসে দাঁড়ালো মরিয়ম।
সন্তানদের মুখের অন্ন জোগাড় করতে দিশেহারা মরিয়ম। এ সমাজে অসহায় মেয়ে মানুষকে লুটেপুটে খেতে চায় শেয়াল-কুকুরের দল। মরিয়ম নিজেকে এসব জন্তু-জানোয়ারগুলোর কাছ থেকে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে।
এক একটা দিন, একটা বছরের সমান মনে হতে লাগলো মরিয়মের। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। না খেতে পেয়ে হাড় আর চামড়া ছাড়া বাচ্চাগুলোর শরীরে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আত্মীয়-স্বজনরা প্রথম কিছুদিন একটু-আধটু সাহায্য করলেও পরে আর তাদের পাত্তা পাওয়া যায়নি।
জীবন যুদ্ধে দিশেহারা মরিয়ম যখন ডুবতে বসেছিলো, তখন পাশের গ্রামের দিলু শেখ মরিয়মকে আশার আলো দেখালো। মরিয়মকে ইটভাটার কাজের সন্ধান দিলো। যদিও সে কাজের জন্য তাকে যেতে হবে দেশের অন্য প্রান্তে “সাতক্ষীরা”।
ইটভাটার মালিকরা উত্তর অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের বছর চুক্তিতে কিনে নিয়ে যায়। উত্তর অঞ্চলের অভাবী মানুষগুলো হয়ে যায় এ যুগের দাস। এক বছরের জন্য তাদের কাজের চুক্তি হয়। এক বছরের আগে তারা কাজ ছেড়ে আসতে পারবে না। বছর চুক্তির অর্ধেক টাকা আগেই দিয়ে দেওয়া হয়। অঙ্গিকারনামায় সই করে, পরিবারকে চুক্তির টাকা দিয়ে অজানা পথে পাড়ি জমায় ইটভাটার শ্রমিকরা। মরিয়ম বেগমও সই করেছে চুক্তিপত্রে, তারপর পেয়েছে ১২ হাজার টাকা। ১২ হাজার টাকা দুই ছেলের হাতে গুজে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে পা বাড়িয়েছে নতুন জীবনে। দাসত্বের জীবনে।
কলিজা ছেঁড়া ধন দুটোকে গ্রামে রেখে যেতে ভেঙ্গে যাচ্ছিল তার বুক। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুরী দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে কালিজা টুকরো টুকরো করছে। তবুও অসহায় মরিয়মকে ছেড়ে আসতে হয়েছে তার ছেলেদের ।
নতুন জায়গার আর নতুন পরিবেশে কিছুটা স্তিমিত হয়ে পরে মরিয়ম। ইটভাটার কঠোর পরিশ্রমে চোখে-মুখে আঁধার দেখে সে। তবুও ফিরে যাবার পথ নেই। মহাজনের কাছ থেকে সই করে টাকা নিয়েছে সুতরাং বছর শেষ না হলে কিছুতেই মুক্তি পাবে না সে।
ইটভাটার একপাশে ছোট ছোট ঝুুপরির মতো ঘর তোলা আছে। ওখানেই গাদাদাগি করে থকতে হয় সবাইকে।
পুরুষ ও মহিলাদের জন্য অবশ্য আলাদা ঘর আছে। ঘর না বলে মুরগীর খোপ বলাই ভালো। ছোট একটা কামড়ায় দশ-বারোজনকে থাকতে হয় তাদের। তার উপর কারো কারো আবার বাচ্চা কাচ্চাও আছে। ঠাসাঠাসি করে কোনমতে রাত পার করে এখানের মানুষগুলো। মরিয়ম অবশ্য নিজেকে এখন মানুষ না ভেবে দাস ভাবে। যে দাসের কোন স্বাধীনতা নেই। মুখ আছে, কথা বলার অধিকার নেই। অমানুষিক পরিশ্রমে প্রতিবাদের ভাষা নেই।
আধপেটা খেয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করার পরও লাঠি ঝাটা খেতে হয় তাকে। তবুও ইটভাটার জীবন থেকে মুক্তি নেই তার।
ইটভাটার আগুনে শুধু ইট পুড়েই লাল হয় না সাথে অঙ্গার হয় মরিয়মের মতো অসহায় মানুষগুলোর জীবনও।
ভাটার চিমনির ধোঁয়া গোল গোল কুন্ডলি পাকিয়ে উড়ে যায়। মরিয়ম সেদিকে তাকিয়ে থাকে ওর মনে হয় এ ধোঁয়া তার কলজে পোড়া ধোঁয়া।
মরিয়মের পাশাপাশি ছোট্ট হীরাও কাজ করে মায়ের সাথে। হীরার বাপ বেঁচে থাকতে হীরা স্কুলে যেত। কিন্তু এই ইটভাটায় স্কুলের স্বপ্ন দেখার অধিকার তার নেই। মায়ের সাথে তাই সে কাজ করে। মায়ের কাজের বোঝা একটু কমাতে চায় সে। হীরার কচি মুখ যখন রোদের তাপে লাল হয়ে যায় তখন মরিয়মের চোখ বেয়েজল গড়ায়। শীতের রাতে যখন হীরা কুচিমুচি ধরে শুয়ে থাকে তখন মরিয়মের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ছেঁড়া আঁচল দিয়ে ওকে ঢেকে রাখে মরিয়ম। অন্য দুই সন্তানের জন্য হুহু করে মায়ের বুক।
সকাল থেকে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হীরা। সকালে শুধু একটা শুকনো রুটি খেয়েছে সে। আসলে মহাজন শুধু মরিয়মের খাবার দেয়। হীরার জন্য আলাদা কোন খাবার বরাদ্দ নেই।
এক জনের খাবার দুজন ভাগ করে খায়। সকালে দুইটা শুকনো রুটি দেওয়া হয় প্রত্যেককে। মায়ের ভাগের রুটি থেকে একটা খেয়েছে হীরা। এখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। কুয়াশা উধাও হয়ে গেছে। চারিদিকে ঝকমকে রোদ। শীতের মিঠা রোদে এখন কড়া ঝাঁঝ। হঠাৎ হীরার মাথাটা ঘুরে ওঠে। সে ঘুরে পরে যায়। কাঁচা ইটের উপর পরে যাওয়ায় অনেকগুলো ইট ভেঙ্গে যায়।
সাথে সাথে ছুটে আসে মহাজন। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে হীরার উপর। অসুস্থ বাচ্চাটাকে এলোপাতারি লাথি মারতে থাকে সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগাল। মহাজন বলে-“ছোট লোকের বাচ্চা, তুই আমার এতো বড় ক্ষতি করলি! আজ থেকে তোর মায়ের খাবার বন্ধ। আর এসব ইটের দাম বাবদ এক হাজার টাকাও কাটা।”
মার খেতে খেতে জ্ঞান হারায় হীরা। শুধু একবার মাগো বলে চিৎকার দেয় সে। হীরার চিৎকারে বাজপাখির মতো ছুটে আসে মরিয়ম। মেয়েকে এভাবে পরে থাকতে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। অন্য শ্রকিমরা এগিয়ে আসে মরিয়মের কাছে কিন্তু মহাজন তাদের গালাগাল করে কাজে ফেরত পাঠায়।
মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে যায় মরিয়ম। বহু কষ্টে হীরার জ্ঞান ফেরায়। হীরার তলপেটে আর পাঁজরে প্রচন্ড ব্যাথা। হীরার গায়ে প্রচন্ড জ্বর এসেছে। জ্বরের চোটে কুঁকড়ে উঠে হীরা। প্রলাপ বকতে থাকে সে।
কি সুন্দর বাগান! আমি ওখানে যাব মা! আমি খেলবো ওই বাগানে। কত ফুল, পাখি ওখানে। আমি দোলনায় চড়বো। ফুলের সাথে গল্প করবো, পাখির সাথে গান গাইবো।”
ওদিকে দুপুর গড়িয়ে এলো অথচ মহাজন সত্যি সত্যি খাবার দেয়নি মরিয়মের। খিদের জ্বালায় পেটে ব্যথা করছে মরিয়মের।ওদিকে অসুস্থ হীরাও না খেয়ে আছে। অসুস্থ, ক্ষুধার্ত মেয়েকে একমুঠো ভাত দিতে না পারার দুঃখে ছটফট করে মরিয়ম।
এমন সময় করিমন বু নিজের ভাগের অর্ধেকটা ভাত নিয়ে মরিয়মকে দেয়। হীরাকে ভাতটুকু খাইয়ে দিতে বলে। গরীবই কেবল বোঝে গরীবের দুঃখ। বড়লোক জানে কেবল রক্তচুষতে।
ভাতের থালা মরিয়মের চোখের পানিতে ভেসে যায়। এই ভাতের জন্যই এতো কষ্ট করা। ছোট ছোট ছেলেদের ফেলে নিজ দেশেই প্রবাসী হয়ে থাকা। এই পেটের ক্ষুধা নামক রাক্ষুসীর জন্যই আজ সে কৃতদাস। তার বাঁচার অধিকার নেই, কথা বলার অধিকার নেই।
মরিয়ম প্রচন্ড আক্ষেপে নিজের পেটে নিজেই ঘুষি মারতে থাকে।মরিয়ম চিৎকার করে কাঁদে আর বলে “গরীব যখন বানাইছো পেট কেন দিলা? আর পেট যখন দিছো আল্লাহ খিদা কেন দিলা?”
মরিয়মের কষ্ট আর আহাজারীতে সবার বুকটা হাহাকার করে। চোখ থেকে অশ্রু গড়ায়। কিন্তু তারাও যে কৃতদাস। প্রতিবাদ করার ভাষা সবাই হারিয়ে ফেলেছে।
রাতে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে হীরার জ্বর। সারারাত মরিয়ম ওর পাশে জেগে বসে আছে। হীরার শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। রহিম চাচা পানিপরা দেয়, দোয়া পরে ফু দেয়। কিন্তু জ্বর আর কমে না। জ্বরে ছটফট করতে থাকে ছোট হীরা।
মরিয়ম দৌড়ে মহাজনের কাছে যায়। হীরার জীবন বাঁচাতে কিছু টাকা চায়। একটা ডাক্তার ডাকতে অনুনয়-বিনয় করে। কিন্তু মহাজন উল্টো গালাগাল করে মরিয়মকে। মরিয়ম উপায় না পেয়ে মহাজনের পায়ে ধরে। মহাজন লাথি মেরে ফেলে দেয় মরিয়মকে।
ভোরের দিকে হীরার ছটফটানি কমে যায়। অনেকট শান্ত হয়ে যায় সে। হীরার ঠোঁটে হাসির ঝলক। এতোদিন পর সে তার বাবাকে দেখছে। কি সুন্দর সাদা জামা পরা বাবা! বাবা নিতে এসেছে তাকে।
হীরা মাকে বলে “মা আমি বাবার সাথে যাবে। দেখ বাবা আমাকে নিতে এসেছে”।
মরিয়ম পাগলের মতো চিৎকার করে। মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখে। তার সাত রাজার ধনকে ভিক্ষা চায় খোদার কাছে। মরিয়মের কোলে মাথা রেখে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যায় হীরা।
দুনিয়ার সব জ্বালা যন্ত্রনার অবসান ঘটিয়ে সে তার বাবার কাছে চলে যায়। এখন আর তাকে না খেয়ে থাকতে হবে না। কেউ তাকে মারতে পারবে না। গালাগাল দিতে পারবে না। দুনিয়ার কৃতদাসের জীবন থেকে আজ সে মুক্ত।
হীরার মাথাটা কোলের উপর রেখে নিস্তব্ধ হয়ে আছে মরিয়ম। তার চোখের অশ্রু ফুরিয়ে গেছে। পাথরের মর্তির মতো বসে আছে সে অথচ আশেপাশে সবার চোখে পানি।
ফজরের আযান হলো, রাত শেষ। একটু পরেই চারিদিকে আলো ফুটবে। রহিমন বু এসে মরিয়মকে ডাক দেয়। হীরার শেষ যাত্রার আয়োজন করতে হবে। মরিয়ম তবুও নিরব। রহিমন বু পরম মমতায় হাত রাখে মরিয়মের কাঁধে, অথচ পিলারের মতো হেলে পড়ে যায় সে।
ছোট হীরা এক একা কী করে পৌঁছাবে তার বাবার কাছে? তাইতো মরিয়ম ও হীরার সাথী হয়েছে।
বিঃদ্রঃ গল্পে ব্যবহার করা ছবিগুলো সংগৃহীত। মূল গল্পের চরিত্রের সাথে এগুলোর কোন সম্পর্ক নেই।