‘বিশ্বব্যাংককে খুশি করতে জেলে পাঠানো হয় আমাকে’
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনিঃ
প্রশ্নঃ দু’জন মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে আপনাকে কেন মামলার প্রধান আসামি করা হলো?
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি করার সাহস পায়নি। প্রধানমন্ত্রীও মন্ত্রীদের নামে মামলা দেওয়ার বিষয়ে সায় দেননি। কারণ, দুর্নীতির মামলায় মন্ত্রীদের আসামি করা মানে সরকারকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রমাণিত করা। সারাবিশ্বে বিষয়টি প্রচার হতো। এ জন্য দু’জন মন্ত্রীকে আসামি করা হয়নি। আর মন্ত্রীর পরের ব্যক্তি হলেন সচিব। তাই সচিব হিসেবে আমাকে মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছিল।
প্রশ্নঃ আপনাকে কেন জেলে যেতে হলো?
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বিশ্বব্যাংককে খুশি করার জন্যই আমাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। সরকারের ধারণা ছিল, আমাকে জেলে পাঠালে বিশ্বব্যাংক খুশি হয়ে ঋণ দেবে। কিন্তু আমি জেলে যাওয়ার পরও বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ দেয়নি। কারণ, আমাকে জেলে পাঠানোর পরও বিশ্বব্যাংক খুশি হয়নি। অথচ দুদকের মামলার দু’দিন পরই ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি, আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এরপর ২০১২ সালের ২৬ ডিসেম্বর জামিনের জন্য হাইকোর্টে যাই। কিন্তু বিচারক বললেন, এক সপ্তাহ পর রেগুলার বেঞ্চ বসবে, এটি তখন রেগুলার বেঞ্চে ওঠাবেন। এরপর কোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পথে দুদক আমাকে ও তৎকালীন সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার ফেরদাউসকে গ্রেপ্তার করে। অবশেষে সাত দিনের রিমান্ড শেষে ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি জেলে যেতে হয়।
প্রশ্নঃ সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে আপনি জেলে যাওয়ার পরও বিশ্বব্যাংক খুশি হয়নি কেন?
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে জেলে পাঠানোর টার্গেট ছিল বিশ্বব্যাংকের। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাকে জেলে পাঠানোর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁদের প্রস্তাবে সম্মতি দেননি। ফলে আমাকে জেলে পাঠানোর পরও বিশ্বব্যাংক খুশি হতে পারেনি।
প্রশ্নঃ কীভাবে জেল থেকে বের হলেন?
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: আমার স্ত্রীর অনুরোধে ড. মসিউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে আমার জামিনের বিষয়টি তোলেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রীকে ফোন করে আমার জামিনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। আইনমন্ত্রী জেলা জজকোর্টে মেসেজটি পৌঁছান। এরপর ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আমার জামিন হয়।
প্রশ্নঃ জেল থেকে বের হয়ে চাকরিতে যোগদান করলেন কীভাবে?
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: জেলে যাওয়ার পর সাময়িক বরখাস্ত ছিলাম। এরপর প্রধানমন্ত্রী বলারও দুই মাস পর ২০১৩ সালের ৬ জুন সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। চাকরিতে পুনর্বহাল হলেও দেড় বছর ওএসডি করে রাখা হয়েছিল। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সদস্য হিসেবে পদায়ন করা হয়। তখন একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম, অন্তত বসার জায়গা পেলাম। তবে পরবর্তী সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব করে সিনিয়র সচিব হিসেবেও পদোন্নতি দেওয়া হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান করা হয়। বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছি।
প্রশ্নঃ মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন কীভাবে?
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: দুদকের অভিযোগ ছিল, দুর্নীতির জন্য পদ্মা সেতুর মূল্যায়ন কমিটিগুলো আমি পরিবর্তন করেছি। আর বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ, ইভ্যালুয়েশন ঠিকমতো হয়নি। কিন্তু তাদের অভিযোগের বিষয়ে আমি এমন উত্তর দিয়েছিলাম, তারা কোনো প্রতিউত্তর দিতে পারেনি। অবশেষে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পায়নি দুদক। মামলার দেড় বছরের বেশি সময় পর এ মামলার রিপোর্ট চূড়ান্ত করা হয়।