৫ বছরে ১২ হাজার নারী-কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা, ৬ হাজারের বেশি ধর্ষণ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়নের বিশ্বব্যাপী উদযাপন হলেও, বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক এবং কঠিন বাস্তবতাকেই তুলে ধরে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ হাজার ৭৫৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৬ হাজার ৩০৫ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
আরও আশঙ্কার বিষয় হলো, যাদের ধর্ষণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৪৭১ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, যা মোট ঘটনার ৫৫ শতাংশেরও বেশি।
এর মধ্যে ১ হাজার ৮৯ জন নারী ও কন্যাশিশুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২০৭ জনকে যৌন সহিংসতার পর হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১৮ জনই শিশু।
এছাড়া, অন্তত ৫০ জন ভয়াবহ সহিংসতার ট্রমা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।
নারীর প্রতি সহিংসতার পরিধি কেবল ধর্ষণ নয়, এর বাইরেও বিস্তৃত।
গত পাঁচ বছরে ২ হাজার ৬২৪ জন নারী ও মেয়ে শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এইচআরএসএসের তথ্য অনুসারে, এই সময়ে যৌতুকের জন্য ৩৫৫ জনকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৬ জন আত্মহত্যা করেছেন।
যৌতুক-সম্পর্কিত সহিংসতায় ২৯০ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে।
একই সময়ে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় ১ হাজার ২৬২ নারী নিহত, ৩৮৬ জন আহত এবং ৪১৬ জন আত্মহত্যা করেছেন।
অ্যাসিড হামলায় ৯৪ জন নারী ও কন্যাশিশু আহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৯ জন এই ভয়াবহ হামলার ঘটনায় মারা গেছেন।
২০২৫ সালেও পরিস্থিতি একইরকম রয়ে গেছে, প্রথম দুই মাসের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক।
অন্তত ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১০৭ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬৬ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
আরও ২৭ জন নারী ও শিশুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৯ জন যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ১৬ জনই শিশু। যৌতুক-সম্পর্কিত সহিংসতার কারণে মারা গেছেন ছয় জন নারী, আহত হয়েছেন দুই জন।
পারিবারিক সহিংসতায় ৫৮ জন নারী প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন আত্মহত্যা করেছেন। অ্যাসিড হামলায় মৃত্যু হয়েছে একজনের।
এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, বৈষম্য এবং নারীবিদ্বেষের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন।
‘শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে কুসংস্কার এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ কারণ,’ বলেন তিনি।
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, ‘যদিও আরও বেশি নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, অনেক এলাকায় এটি এখনো ট্যাবু হিসেবে রয়ে গেছে, যা তাদের নিরুৎসাহিত করে এবং নানা বাধার সম্মুখীন করে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো, ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর বিকাশের পথে বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, পুলিশের উদাসীনতা এবং বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতায় অপরাধীদের শাস্তি এড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়।’
তিনি বলেন, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অনেক সময় নারীদের আইনি সহায়তা নিতে বাধা দেয়, যার ফলে তারা যথাযথ আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মোসলেম পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।
‘ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, মোরাল পুলিশিং এবং মব সন্ত্রাস নারীর ইস্যুগুলোকে একটি বৃহত্তর সামাজিক উদ্বেগে পরিণত করেছে, যার জন্য কেবল নারী নয়, সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন,’ বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘সমাজ বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে অরাজকতা এবং অপরাধমূলক দায়মুক্তি বাড়ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা, সমঝোতা এবং জবাবদিহিতার অভাব অপরাধীদের ক্ষমতায়ন করছে।’
তিনি বলেন, যদি সামগ্রিকভাবে সমাজ জেগে না ওঠে, তাহলে এই সংকট মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
তিনি আরও বলেন, ন্যায়বিচার সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, যারা নারী অধিকারের বিরোধিতা করে এবং পুরো ব্যবস্থাকে এক্সপ্লয়েট করে তাদের আরও ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততা, নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিদের নীরবতা এবং আইনবিরোধী মনোভাব—এসবই নারীর প্রতি সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।
সমাজকর্মী খুশি কবিরও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়েছি যেখানে কিছু লোক বিশ্বাস করে যে তাদের অন্যদের ওপর নির্যাতন করার অধিকার রয়েছে। কিছু ব্যক্তি, যারা সামাজিক নিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করে, তারা জনগণের কিছু সদস্যের সমর্থন নিয়ে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে, যা বিষয়টিকে আরও খারাপ করে তোলে।’
‘মূল সমস্যা হলো আমাদের দেশের দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই এবং প্রায়শই জনগণ অপরাধীদের সমর্থন করে। এটি সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।’
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অবশ্যই পূরণ করতে হবে এবং নারীর অধিকার, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
‘নারীরা যাতে নিরাপদে এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।
এইচআরএসএস সরকারকে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মামলায় দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং দ্রুত বিচারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে সংগঠনটি।
সেইসঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সাইবার হয়রানি মোকাবিলা এবং নারীদের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে।