৩ হাজার বছরের রহস্যময় ‘তখত-ই সোলায়মান’: ইরানের প্রাচীন সভ্যতার বিস্ময়
ইরানের পশ্চিম আজারবাইজানের পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে অবস্থিত তখত-ই সোলায়মান এক অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা, যার বয়স ৩ হাজার বছরেরও বেশি। প্রাচীন এই ঐতিহাসিক নগরী একসময় ছিল সাসানিয় যুগের জরথুষ্ট্রীয় উপাসনার কেন্দ্র। আজও এর ধ্বংসাবশেষ, অগ্নিমন্দির ও রহস্যময় স্থাপনা ইতিহাসবিদ ও ভ্রমণপ্রেমীদের মুগ্ধ করে।

ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান
২০০৩ সালে তখত-ই সোলায়মানকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। সংস্থাটির মতে, সাইটটি সাংস্কৃতিক, স্থাপত্যিক ও ধর্মীয় গুরুত্বের দিক থেকে অতুলনীয়। সাসানিয় যুগের অগ্নিমন্দির এবং দুর্গনগরীর এই ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন জরথুষ্ট্রীয় ধর্মচর্চার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
ইউনেস্কোতে প্রাচীন সাইটির অন্তর্ভুক্তি এর অসামান্য সার্বজনীন মূল্য এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্যবাহী স্থানটি রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে।

তখত-ই সোলায়মানে প্রাচীন মন্দির
প্রাচীন লিপি অনুযায়ী, তখত-ই সোলায়মানকে অনেকেই জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান মনে করেন। এটি প্রাক-ইসলামিক যুগে ইরানিদের জন্য একটি বৃহৎ শিক্ষা ও সামাজিক কেন্দ্র এবং উপাসনালয় ছিল। কিন্তু ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের আক্রমণে এটি ধ্বংস হয়ে যায়।
এই স্থানটিতে বেশ কয়েকটি চিত্তাকর্ষক স্থাপনা রয়েছে যা প্রাচীন পারস্যদের স্থাপত্য এবং নকশা দক্ষতা প্রদর্শন করে। তখত-ই সোলায়মানে প্রধান স্থাপনার মধ্যে রয়েছে আজারগোশাস্প মন্দির এবং আনাহিতা মন্দির।

অজরগোশাস্প অগ্নিমন্দির ও আনাহিতা মন্দির
সাইটটিতে থাকা স্থাপনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অজরগোশাস্প অগ্নিমন্দির, যা জরথুষ্ট্রীয় ধর্মে অগ্নিপূজার প্রধান কেন্দ্র ছিল। মন্দিরের নকশায় একটি কেন্দ্রীয় উঠোন রয়েছে যা একাধিক কক্ষ এবং হল দ্বারা বেষ্টিত। মন্দিরটি কেন্দ্রীয় উঠান ঘিরে নির্মিত এবং দেয়ালে খোদাই রয়েছে জরথুষ্ট্রীয় পুরাণের নানা দৃশ্য।
এ ছাড়া রয়েছে আনাহিতা মন্দির, যা পার্থিয়ান যুগে নির্মিত এবং এটি পানি ও উর্বরতার দেবী আনাহিতার উদ্দেশে উৎসর্গকৃত ছিল। মন্দিরটিতে একটি আয়তাকার নকশা রয়েছে। এই নকশায় আছে একটি কেন্দ্রীয় হল, যেটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত হতো। মন্দিরের দেয়ালগুলো সুন্দর ফ্রেস্কো দিয়ে সজ্জিত, যা পারস্যের ইতিহাস এবং পৌরাণিক কাহিনীর দৃশ্যগুলো চিত্রিত করে।

তখত-ই সোলায়মানের কাছে দানব কারাগার
তখত-ই সোলায়মান থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে এক শঙ্কু-আকৃতির পাহাড়, যাকে স্থানীয়রা বলেন ‘দৈত্যের কারাগার’ বা ‘প্রিজন অব সোলায়মান’। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও খনিজস্তর জমে হাজার বছরের প্রক্রিয়ায় তৈরি এই পাহাড়ের ভেতরে রয়েছে এক গভীর গর্ত।
লোককথায় বলা হয়, রাজা সোলায়মান অবাধ্য দৈত্যদের এই গর্তে বন্দি করে রেখেছিলেন। পাহাড়ের চূড়ায় থাকা প্রাচীন পাথরের স্থাপনার নিচে রয়েছে সেই অন্ধকার গহ্বর। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এর ভেতরে প্রবেশ করলে কেউই জীবিত ফেরত আসে না।
সাসানীয় রাজবংশের যুগে (২২৪ থেকে ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) নির্মিত, শঙ্কু আকৃতির কারাগারটি জরথুস্ত্রীয় পুরোহিতদের বলিদান এবং প্রার্থনার স্থান ছিল। পাহাড়টি হাজার হাজার বছর ধরে একটি প্রাচীন হ্রদের খনিজ পাথরের পলি স্তর দ্বারা আকৃতি পেয়েছে। ৮৩০ থেকে ৬৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে এটি একটি মন্দির ছিল যেখানে চিকিৎসার জন্য বেশ কয়েকটি সালফার উষ্ণ প্রস্রবণ ছিল।
অতীতে এখানকার সালফারসমৃদ্ধ গরম পানির উৎসগুলো চিকিৎসায় ব্যবহার হতো। খনিজ জমাট স্তরের কারণে পাহাড়টি অন্যান্য আগ্নেয় পাহাড়ের মতো নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে অবক্ষেপিত খনিজ স্তর দ্বারা গঠিত। এই অঞ্চলে একটি ঝর্ণাও ছিল যা সময়ের সাথে সাথে একটি হ্রদে পরিণত হয়। এর পানি ছিল লবণ এবং সালফার দিয়ে ভরা।

সময়ের সাথে সাথে, লবণগুলো হ্রদের তলদেশে জমা হয় এবং কঠিন পলি স্তরে পরিণত হয়। এখন হাজার হাজার বছর পরে, স্তরগুলো ভিতরে গর্তসহ একটি পাহাড়ের আকার ধারণ করেছে। ধীরে ধীরে হ্রদটি শুকিয়ে গেছে, কিন্তু এর অবশিষ্টাংশ এখনও দৃশ্যমান। স্থানটি এখন পর্বতারোহীদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি।
‘দানব কারাগার’-এর অদ্ভুত গল্প
সোলায়মান কারাগার বা দানব কারাগার হলো ১০০ মিটার উঁচু শঙ্কু আকৃতির একটি পাহাড়, যার ভেতরে একটি ভয়ংকর গর্ত রয়েছে। এটি নিয়ে এক অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে।
পাহাড়ে উপরে সরোজ মর্টার দিয়ে তৈরি একটি পাথরের ভবন রয়েছে। ভবনটির ভেতরে একটি কৃষ্ণগহ্বর লুকিয়ে আছে, যার বাইরে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই এবং যদি কেউ ভিতরে পা রাখে, তাহলে সে অবশ্যই মারা যাবে।

কিছু স্থানীয় লোক বিশ্বাস করত যে রাজা সোলায়মান একটি রাক্ষসকে বন্দী করেছিল এখানে এবং তাকে পাহাড়ের কৃষ্ণগহ্বরে আটকে রেখেছিল। তারপর তার উপরে একটি ভবন স্থাপন করে তার কৃষ্ণগহ্বরকে আরও শক্ত করে তুলেছিল।
লোককথায় আরও বলা হয়, কৃষ্ণগহ্বরে থাকা রাক্ষস হলো সেই শয়তান যে সোলায়মানের কাছ থেকে প্রভুর নাম লেখা একটি বিশেষ আংটি চুরি করেছিল। রাক্ষসটিকে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ক্রোধপূর্ণ প্রাণী বলে মনে করা হতো। তার মুখ থেকে বের হতো বিষাক্ত গ্যাস। স্থানীয়রা মনে করতো, যেই কৃষ্ণগহ্বরে পা রাখার সাহস করবে, তাকে রাক্ষস হত্যা করবে। সেই কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে দানব কারাগার।
রোমাঞ্চকর ভাসমান দ্বীপের হ্রদ
তখত-ই সোলায়মান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে রহস্যময় এক হ্রদ, যাকে বলা হয় ভাসমান দ্বীপের লেক। গভীরতার দিক থেকে এটি ১১২ মিটার পর্যন্ত নেমে যায় এবং খনিজসমৃদ্ধ পানির কারণে এর উপরিভাগে ভাসে ঘন সবুজ উদ্ভিদের তৈরি প্রাকৃতিক ভাসমান দ্বীপ। শীতকালেও এটি সবুজ থাকে এবং বাতাসের সঙ্গে ধীরে ধীরে নড়ে।

এই প্রাকৃতিক ঘটনা স্থানীয়দের কাছে যেমন বিস্ময়, তেমনি বিজ্ঞানীদেরও আকর্ষণ করেছে। যদিও এর সঙ্গে যুক্ত অনেক কিংবদন্তি যেমন— সোলায়মানের গুপ্তধন বা জাদুর আংটির গল্প ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়।
সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রকৃতির সম্মিলিত বিস্ময়
তাখতে সোলায়মান শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ নয়; এটি প্রাচীন সভ্যতা, পুরাণ, ধর্মীয় আচার, কিংবদন্তি এবং প্রাকৃতিক বিস্ময়ের এক অনন্য সমন্বয়। তাই আজও এটি ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান এবং গবেষকদের কৌতূহলের কেন্দ্র।
সূত্র: মেহের

Comments are closed.