২০২৪: শেখ হাসিনার বিদায়, ‘অচ্ছুত’ আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশের ইতিহাসে আকারে ও তাৎপর্যে বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থান করবে ২০২৪ সাল।  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে এক বিশাল গণবিস্ফোরণে উড়ে যায় স্বৈরাচারী সরকারের ১৫ বছরের লৌহকঠিন  শাসন ব্যবস্থা।

এর মধ্য দিয়ে অনেকের কাছেই অপরাজেয় হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার বিদায় ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগও হয়ে পড়ে রাজনৈতিকভাবে কার্যত অচ্ছুত হয়ে পড়েছে।

জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে। তখন আন্দোলন দমাতে চলছে গুলি। ছাত্র-জনতার লাশ পড়ছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। এরই মধ্যে নিজ কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ হাসিনা বললেন, ‘আন্দোলনের মধ্যে গুজব ছড়ানো হয়েছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বলে দিতে চাই, শেখ হাসিনা পালায়নি, পালায় না।’

২২ জুলাই শেখ হাসিনা এ বক্তব্য দেন। ১৩ দিনের মাথায় তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। যার মধ্য দিয়ে অবসান হয় দেড় দশকের জুলুম-জালিয়াতির শাসন।

স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়োগান্তক হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছিল দাবি করা হয়। তবে এবারের বিষয়টিকে আলাদা ভাবেই মূল্যায়ন করছেন বিশ্লেষকরা। ১৯৭৫-এর পর রাজনৈতিক বিরূপ সময়েও দলের হয়ে কথা বলার মতো নেতারা দেশে থেকে প্রতিবাদ করেছেন, সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে হয়েছেন হামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার। কিন্তু ২০২৪ সালের ধরাশায়ী আওয়ামী লীগের হয়ে কথা বলার মতো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা দেশে নেই, এমনকি সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও দেশ ছেড়েছেন। অল্পসংখ্যক কয়েকজন নেতা দেশে থাকলেও আছেন আত্মগোপনে। আবার অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধুমাস না পেরোতেই দানা বাঁধে কোটা আন্দোলন। আর তাতেই একদফা আন্দোলনের ফসল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীত্ব পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেইসঙ্গে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি দলের সাধারণ ওবায়দুল কাদের আত্মগোপনে থেকে পাড়ি জমান ভারতে। একইভাবে কেন্দ্রীয় নেতারাসহ সহযোগী সংগঠনের বর্তমান ও সাবেকরাও আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে।

আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দলের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে দীর্ঘ ২১ বছর পর। ২০০১ সালে নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে বিরোধী দলে থেকে আবারও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। কিন্তু ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে ক্ষমতায় থেকে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করলেও রুখতে পারেননি দুর্নীতি। একটি চক্র অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এরই বহিঃপ্রকাশ গত ৫ আগস্ট। ধরাশায়ী হয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি।

ক্যাম্পাস থেকে গণভবনে শিক্ষার্থীরা

২০২৪ সাল বিভিন্ন কারণেই সবার মনের মধ্যে গেঁথে থাকবে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকবে জুলাই ও আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের কারণে। যেটিকে আন্দোলনকারীরা শিক্ষার্থী-জনতা নাম দিয়েছেন ‘জুলাই বিপ্লব’। ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দলটির টানা সাড়ে ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের শাসনের অবসান হয়। রচিত হয় নতুন ইতিহাস।

ঘটনাবহুল ২০২৪ সালের শুরুতে ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগের দুই নির্বাচনের মতো এটাও ছিল পাতানো নির্বাচন। তবে প্রতিটি নির্বাচনে জেতার পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। ২০১৪ সালে ছিল একতরফা বা বিনা ভোটের নির্বাচন। ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল আরও জালিয়াতিপূর্ণ; যা ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। ২০২৪ সালে এসে হয় ‘ডামি নির্বাচন’। বিএনপিসহ ছোট-বড় অনেক দলের বর্জনের মুখে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত এই নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগে নিজ দলের ‘ডামি’ প্রার্থী দাঁড় করায়। আওয়ামী লীগ ও ডামি আওয়ামী লীগ (দলের স্বতন্ত্ররা) মিলে ২৮০টি আসন পায়। তার আগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও সাজা দিয়ে কোণঠাসা করা হয়।

 

You might also like

Comments are closed.