পৃথিবীকে আলোকিত করবে ২০২০ এর আরেকটি নতুন সূর্যোদয়। বিদায়ী বছরের সূর্যাস্তের সাথে শেষ হলো রুদ্ধশ্বাস দুর্ধর্ষ ২০১৯ এর হলফনামা। বছরটি আমার জীবনের অন্যতম সাফল্য ও সংগ্রামের বছর।
খবরের শিরোনাম হাওয়া থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পিস টর্চ আওয়ার্ড, অনন্যা, মিস আর্থ কুইন ও গেম চেঞ্জারের মত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা পেয়েছি এ বছর। ২০১৯ এর এই যাত্রাপথে পরিচয় হয়েছে দেশ-বিদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের সাথে।
কিন্তু এর পেছনে পৃথিবীর পথে পথে আমার অভিযাত্রায় বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। ২০১৯ এ আমার কিছু সংগ্রাম এখনো আমাকে পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে ফিরে নিয়ে যায় টুকরো টুকরো স্মৃতির পাতায়।
পশ্চিম আফ্রিকা ও সেন্ট্রাল আমেরিকার সবচেয়ে দুর্গম পথে অভিযাত্রা করতে হয়েছে এ বছর। মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছি অনেকবার। আঘাত পেতে পেতে উঠে দাঁড়িয়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি অনেকবার, নদীর স্রোতের সাথে বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে, অন্ধকারে মধ্যরাতে আফ্রিকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে পথ পার হতে হয়েছে, ঘাসের উপর ঘুমিয়ে রাত পার করতে হয়েছে, পথে খাবার না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় ভুগতে হয়েছে। মরুভূমিতে প্রচন্ড তাপমাত্রা পুড়তে হয়েছে। অভিযাত্রার পথে হঠাৎ একদিন শুনতে হয়েছে আমার ভাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, এমন মানসিক অবস্থার মাঝেও আমাকে পথ চলতে হয়েছে।
কিন্তু তবুও আমি থামিনি, যতক্ষণ শরীরে শক্তি ছিল আমি পৃথিবীর পথে পথে হেঁটেছি। পৃথিবীর মানুষকে দেখেছি পৃথিবীর প্রকৃতিকে দেখেছি পৃথিবীর মাঝে বিচরন করেছি লাল-সবুজের পতাকা হাতে। তাই ২০১৯ আমার জীবনের কঠিন সংগ্রাম, কষ্ট ও অনেক সাফল্যের একটি বৎসর। কিন্তু সবকিছুর জন্যই আমি বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ, আমার সকল যুদ্ধের মাঝে আমি এখনো বেঁচে আছি , নিশ্বাস ফেলছি পৃথিবীর ১৩৫ দেশে বাংলাদেশের পতাকাকে পৌঁছে দিয়ে। কিন্তু এবছরের অভিযাত্রার কিছু কঠিন মুহূর্ত আমাকে পরবর্তী বছর গুলতে নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
১.
একদিন বৃষ্টিমুখর দুপুরে নিকারাগুয়ার সেরো নেগ্রো মাউন্টেনের ভলকানিক সামিটের চূড়ায় তখন আমি। হঠাৎ করে প্রবল বৃষ্টি বর্ষণের সাথে সাথে শুরু হয় শিলা বর্ষণ। বৃষ্টির পাশাপাশি আমার মাথার উপর অঝরে পড়তে লাগলো শিলাবৃষ্টির খণ্ড খণ্ড টুকরো। আমি কোন ভাবে দুই হাত দিয়ে মাথাকে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে লাগলাম। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলোনা। আমি বিকল্প পথ খুঁজতে থাকি। দুস্তর পর্বতের চূড়ায় তখন আশ্রয় নেওয়ার কোন জায়গা নেই, একদিকে আগ্নেয়গিরি, অন্যদিকে পর্বত জুড়ে কয়লার মত জ্বলে যাওয়া শিলা নুড়ি পাথর কনা। বড় কোন পাথরের শরীরের সাথে লেগে কিছুটা হলেও বাঁচা যায় কিনা খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু বড় একটা পাথর অনেক দূরে ছিল, আমি সেখানে পর্যন্ত যাওয়ার কোন পথ খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ মাথায় এলো আমার ভলকানিক বোটের কথা। আমি তৎক্ষণাৎ ভলকানিক বোট (যে বোটে করে আমরা পাহাড়ের উঁচু চূড়া থেকে নিচ পর্যন্ত নামবো) অর্থাৎ কাঠের বড় একটা টুকরো মাথার উপর দিয়ে ধরে রাখলাম। ঠিক পনেরো মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কোনভাবে রক্ষা হল আমার মাথা, কিন্তু হাতে কোন বোধ শক্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শিলাবৃষ্টির কিছুটা আঘাতে হাতে তখন কোথাও কোথাও রক্ত জমাট বাঁধলো। শিলা পড়া বন্ধ হলেও বৃষ্টি তখনো থামেনি। যেকোনো মুহূর্তে ভয়ানক ঝড় হতে পারে ওই চূড়ায় তখন আর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। আমরা তখন প্রস্তুত। এই বৃষ্টির মধ্যেই রিস্ক নিয়েই শিলা, পাথর কনা, নূড়ির উপর দিয়ে বিছিয়ে দিলাম হলুদ রঙের ভলকানিক বোট। সেই বোটের উপর বসে ভয়ানক রিক্স নিয়ে আস্তে আস্তে নামতে থাকলাম পর্বত চূড়া থেকে। কয়েকঘণ্টা হাইকিং করে চূড়ায় উঠার পর, আবার এই দুর্যোগের মধ্যে ভলকানিক বোটে নামার অভিজ্ঞতা ছিলো পুরোটাই নতুন। অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে সেইলিং বোটে করে অভিযাত্রা করার অভিজ্ঞতা ছিল যতটা ভয়ঙ্কর তার থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর এবং রোমাঞ্চকর ছিলো পর্বত থেকে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ভলকানিক বোটে করে নামা।
২. গুয়ান ক্যাসেল প্রদেশে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার নেমে আসছিল। আমি তখন ব্রাসিলিতো নদীর স্রোতের সাথে যুদ্ধ করছি নিজেকে বাঁচানোর জন্য। ছোট্ট নদীটির ঠিক মাঝামাঝি অবস্থায় আমি আটকে আছি সেই মুহূর্তে। পাথরের সাথে জোর করে আমি একটা পায়ের পাতার আংগুল গুটিয়ে নদীর সে পাথরকে আকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম, আমি বুঝতে পারছিলাম পাথরের খোচায় আমার পায়ের এক সাইড দিয়ে কিছুটা কেটে যাচ্ছিল, আমার সেদিকে খেয়াল নেই, আমার এখন বাঁচতে হবে, নতুবা নদীর স্রোতের সাথে আমার শরীর ভেসে যাবে সাউথ প্যাসিফিক সমুদ্রের দিকে। আমি স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে ও যেতে পারছিনা, আবার স্রোতের সাথে ভাসলে আমার শরীর প্রচন্ড পানির উত্তাল ঢেউয়ে চলে যেতে পারে সমুদ্রে, কিন্তু সেদিনও আমি বেঁচে রইলাম কোন অজানা আশীর্বাদে। হঠাৎ করে নদীর অপর পাড়ে সমুদ্রের কাছে দেখতে পাচ্ছিলাম আবছা অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কোন একজন মানব। গলা পর্যন্ত ডুবে যাওয়া শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাকে ডাকলাম, সেই মানবটি দৌড়ে এসে জোয়ার আসা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আমাকে বাঁচালো। সাউথ প্যাসিফিকের পাশ ঘেঁষেই ছিলো কোস্টারিকার অপূর্ব সুন্দর কনচাল সমুদ্র সৈকত। দিনের বেলায় নদীতে যখন ভাটা ছিলো আমরা তিনজন টুরিস্ট বন্ধু একসাথে গিয়েছিলাম এই ব্রাসিলিতো নদী পার হয়ে। দুর্গম সে সৈকত অভিযানে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম একেক জন একেক জায়গায়। ফেরার সময় নদীতে অনেক জোয়ার এসেছিলো, এই অবস্থায় নদীতে আরও প্রবল জোয়ার আসবে ভেবে আমাকে একাই নদী পার হতে হয়েছিল শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে।
৩. ব্রানিও আর আমি গুয়াতেমালা সিটিতে রেস্টুরেন্ট থেকে হেঁটে হেঁটে রাতের খাবার খেয়ে হোস্টেলে ফিরছিলাম। হঠাৎ করে দুজন পেছন থেকে দুটো চুরি নিয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। তাদের পকেটে ছিল আর্মস। আমাদের সঙ্গে থাকা সব মুদ্রা নিয়ে নিতে চাইলো, ব্রানিও ছেলেটির ছুরির আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলে আমি রাস্তার ফুটপাতে পড়ে যেয়ে রক্তাক্ত হই, ছোট পাথর কনা আমার ডান হাতের তালু দিয়ে ঢুকে যায়, হাঁটু থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়। আমি যখন শরীরের সব শক্তি দিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালাম আমার তখন রক্ত বেয়ে পড়ছিল শরীরের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে, ওই অবস্থায় আমি পকেটে হাত দিলাম ডলার মুদ্রা যা ছিল দিয়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু কি যেন মনে করে তৎক্ষনাতই দেখতে পেলাম ছেলেটি ছুরিটি পকেটে ঢুকিয়ে বিপরীত দিকে হাঁটা দিল। আমি আবার বেঁচে গেলাম মিরাকল ভাবে।
৪. নিকারাগুয়া বর্ডার ক্রস করেই প্রায় সতেরো ঘন্টা বাসটি এসে আমাকে নামিয়ে দিল কোস্টারিকার লাইবেরিয়া শহরের মেইন রাস্তার পাশে কোন একটা ঝোপের কোনায়। রাত তখন ১১ টা। চারদিকে থমথমে অন্ধকার। আমি ব্যাকপ্যাক নিয়ে যখনই নেমে পড়লাম, আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল, বুঝতে পারছি গুয়াতেমালায় আমার জখম হওয়া পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। মনের শক্তি দিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলতে থাকলাম। কিন্তু এই অচেনা জায়গায় কষ্ট হলেওতো আমাকে হোস্টেলের ঠিকানায় পৌঁছাতে হবে কোনভাবে সম্পূর্ণ একা। গাড়ি যেখানে আমাকে নামালো সেখান থেকে হোস্টেলটি পাঁচ কিলোমিটার দূরে। মোবাইলে নেট নেই, তাই উবার দেওয়ার চান্স ছিল না। প্রায় ১০ মিনিট হাঁটার পরে দেখতে পেলাম একটা কার রাস্তার পাশ ঘেঁসে দাঁড়াল। তাদেরকে দেখে আমি দৌড়ে কারটির পাশে গেলাম, ড্রাইভিং সিটে দেখতে পেলাম একটি মেয়ে, তার পাশের সিটে একটি ছেলে। দুজনের হাতেই দুইটা প্যাকেটের ভিতরে কোন খাবার, আমাকে দেখেই জানলার গ্লাস খুলে মুখ বের করে দিল মেয়েটি। আমি তার কাছে পথনির্দেশনা জানতে চাইলাম হোস্টেলের। মেয়েটি তার স্পানিশ ভাষায় আমাকে বলল, আমি ইশারায় বুঝলেও খুব বেশি একটা বুঝে উঠতে পারিনি। আমি যখনই কয়টি স্টেপ হাঁটা দিলাম সামনের দিকে, গাড়িটি এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। ইশারা দিয়ে বলল তাদের পেছনের সিটে বসার জন্য, ওরা আমাকে পৌঁছে দিলো হোস্টেল পর্যন্ত। আমি কৃতজ্ঞ হলাম তাদের কাছে। ওই মুহূর্তে ওই রাইডটা আমার খুবই দরকার ছিলো। হয়তো কোনদিন আর দেখা হবেনা এই মানুষগুলোর সাথে। কিন্তু তারা আমার এই জীবন জার্নির ইতিহাসে স্মৃতি হয়ে থাকবে।
৫. তখন মধ্য রাত তিনটা। আফ্রিকার জঙ্গলের ঘন অন্ধকার। ভাঙ্গা মেঠোপথ। দুপাশে জঙ্গলে বন্য প্রাণীর কুহু কুহু ডাক, থমথমে পরিবেশের মধ্য দিয়ে হঠাৎ সত্তর সালের পুরানো গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে পিছনে ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যদি কোন মানববসতি খুঁজে পাওয়া যায়। সাড়ে তিন ঘন্টা ভয়ঙ্কর অন্ধকার পথে হাঁটার পর ভোরবেলা খুঁজে পেলাম এক আদিবাসীর বাড়ি। বাড়ির সামনে পাথরের উপর কাঠের টুকরোর উপর ব্যাকপ্যাক দিয়ে হেলে পড়লাম ক্লান্ত শরীর নিয়ে। টানা আড়াই দিন কোন প্রপার খাবার ছাড়াই বেঁচে থাকতে হলো সেই মুহূর্তে।
বছর ফুরিয়ে যায়, আমরা আবার নতুন নতুন স্বপ্নের মাঝে নতুন করে বেঁচে উঠি। পথে পথে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে করতে পৃথিবীর কাছ থেকে আমি প্রতিনিয়ত অনেক কিছু শিখছি জানছি, আমার দেখার ভান্ডারকে অজানার কাছ থেকে সমৃদ্ধ করছি। সংগ্রাম করে হলেও আমি এই সুন্দর পৃথিবীকে জানছি, পথচলার প্রতিটা মুহূর্তকে ধারণ করছি পৃথিবীতে।
২০২০ সালে আমি দেশ ভ্রমণের রেকর্ডকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাব বাংলাদেশের পতাকা হাতে। দুর্গম পথে চলতে চলতে নতুন করে বাঁচতে শিখবো, রহস্যময় পৃথিবীর পথে অভিযাত্রা করতে করতে নতুন নতুন রোমাঞ্চকর গল্প নিয়ে ফিরবো সবার কাছে। এভাবেই পৃথিবী নামক মাকে দেখতে থাকবো।
ধ্বংস, হিংসা ক্রোধ আর আক্রোশের ঊর্ধ্বে শান্তিময় হোক আমাদের সবার জীবন। সবার জন্য বিলিয়ন মিলিয়ন শুভেচ্ছা, শুভকামনা, দোয়া, ভালোবাসা। নতুন বছরে আপনি হয়ে ওঠুন অন্য সবার জীবনের জন্য একটি প্রতীক।
(বিশ্ব অভিযাত্রার ডায়েরি থেকে)
★বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সর্বাধিক ১৩৫ দেশ ভ্রমণ করে রেকর্ড করেছেন ‘ফ্ল্যাগগার্ল’ খ্যাত নাজমুন নাহার।