হুইল চেয়ারে বসে মহসিনের দেশ-বিদেশ জয়ের গল্প!
সময়টা ছিল ২০১০ সাল। স্রেফ খেয়ালের বসে ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করেন মোহাম্মদ মহসিন। ছবিটিতে দেখা যায় হুইল চেয়ারে বসে ক্রিকেট খেলছেন মহসিন। তখন নিজেও কি ভেবেছিলেন, সে ছবিই সূচনা করবে নিজ দেশের জন্য নতুন এক অধ্যায়ের! সাকিব-মাশরাফি-তামিমদের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারবেন বাংলাদেশের শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও!
মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর কে মহসিন শোনালেন, তার বেড়ে ওঠার গল্প। অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে দেবার বাস্তব গল্প!
১৯৮৭ সালে গাজীপুরের টঙ্গীতে এক কৃষক পরিবারে জন্ম হয়েছিল মহসিনের৷ জন্মের মাত্র ছয় মাস পর প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। জ্বর থেকে শরীর অবশ হয়ে পড়ে। যেভাবে রাখা হত ছোট্ট মহসিনকে সেভাবেই পড়ে থাকতো সে।
‘আমাকে অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখানো হয়। কিছুদিন পর জানা যায় আমার পোলিও। হাটার শক্তি হারাই আমি’, এক নাগাড়ে বলছিলেন মহসিন।
কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ক্রিকেট খেলার চিন্তাটা মাথায় কিভাবে আসলো?
‘আমাদের বাসার কাছেই স্কুল ছিল। হামাগুড়ি দিয়ে স্কুলে যেতাম আমি। তখন চোখে পড়তো পাশের ছোট মাঠে এলাকার ছেলেরা খুব মজা করে ক্রিকেট খেলছে। ওদেরকে বলতাম, আমাকেও তোমাদের সাথে খেলতে নাও। ওরা প্রথমদিকে নিতে চাইতো না, তাড়িয়ে দিতো৷ কিন্তু একটা সময় পর রাজি হয়।’
আর শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে দল গড়ার ভাবনাটা?
‘সেটাই বলছিলাম। ওরা যখন আমাকে খেলায় নিতে রাজি হল তখন আমার আজকের মতো হুইল চেয়ার ছিল না। আমি মাটিতে বসেই খেলতাম। সেটা দেখতে রাস্তার পাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকতো। তখন মনে হলো, আমিতো ওদের সাথে বেশিদিন খেলতে পারবো না। আমার মতো যারা আছে তাদের জন্য ডিজেবল ক্রিকেট টিম আছে কিনা তা খুজতে থাকি।’
সে সময়টাতেই ২০১০ সালে ফেসবুকে পোস্ট করা ওই ছবি দেখে ভারত থেকে হারুনুর রশিদ নামে এক ব্যক্তি মহসিনের সাথে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কোন ক্রিকেট দল আছে কিনা মহসিনের কাছে তা জানতে চান। মহসিন খোঁজ নিয়ে জানলেন, বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ক্রিকেট দল থাকলেও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কোন ক্রিকেট দল নেই।
হারুন তখন মহসিনকে এ নিয়ে কাজ করার জন্য আগ্রহ যোগান। এরপর সাভারে সিআরপি’র প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালরি টেলরের সাথে দেখা করলে তিনি হারুনকে সঙ্গে নিয়ে মহসিনকে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। ২০১৩ ফেব্রুয়ারি মাসের হারুন ঢাকায় এসে বাংলাদেশ দলের সাথে নিজেদের দলের খেলার প্রস্তাব দেন।
টেলর রাজি হন। টেলর মহসিনকে বললেন, বাংলাদেশ দলের জন্য খেলোয়াড় জোগাড় করতে। যেই কথা, সেই কাজ। মহসিনদের পরিচিত এবং সিআরপির কিছু খেলোয়াড় নিয়ে ২০ জনের একটি দল গঠন করা হয়। সিআরপি তে কাজ করা জনৈক বুলবুল তাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন।
বাছাইয়ের পর ১৬ জনকে নিয়ে ২০১৩ সালে তৈরি হয় বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী দল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মহসিনকে মূল দলে নেয়া হয় নি! তিন ম্যাচ সিরিজের একটি ম্যাচও খেলতে পারেননি, দল গঠনের মূল উদ্যোক্তা! কারণ হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী যারা, কর্তৃপক্ষ তাদের মাঠে নামাতে অনীহা প্রকাশ করে। কিন্তু ভারতে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী খেলোয়াড়রা জাতীয় প্রতিবন্ধী দলে সুযোগ পান।
মহসিন খুব কষ্ট পান। তিনি তখন ভাবলেন, এ বৈষম্যের অবসান হতেই হবে। সে ভাবনারই প্রতিফলন ঘটে হুইল চেয়ারে থাকা খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গঠনের মাধ্যমে।
এরপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে চলার। ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মহসিন ভেঙে চলেছেন একের পর এক সীমাবদ্ধতা। ২০১৪ সালে ভারতে একটি টুর্নামেন্টে (তাজমহল ট্রফি) অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরে মহসিনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল। ‘সে টুর্নামেন্টে অংশ নেয়ার জন্য নিজের ফ্লেক্সিলোডের দোকানটা বিক্রি করতে হয়েছিল আমাকে’, হাসিমুখে বলছিলেন মহসিন।
শুধু তাজমহল ট্রফি জয়-ই নয়; ২০১৫ সালে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এই পাঁচটি দেশের দল নিয়ে ‘ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট এশিয়া কাপ’ এ বাংলাদেশ ভারতকে পরাজিত করে। তার আগে নেপালকেও বাংলাদেশ দল পরাজিত করেছিল। মহসিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল ১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে আটটি ম্যাচে জয়লাভ করেছে। এছাড়াও ২০১৭ সালে ঢাকায় ওয়ালটন সিরিজ, ২০১৭ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে রানারআপ, ভারতে অনুষ্ঠিত দুটি টুর্নামেন্টে দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়।
সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে এক সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ মেলে মহসিনের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে গ্রহণ করেন ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এওয়ার্ড’।
বাংলাদেশ হুইল চেয়ার ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন মহসিন শুধু একজন ক্রিকেটারই নন; একজন দক্ষ এবং সফল সংগঠকও বটে। তিনি হুইল চেয়ার ক্রিকেট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড এর প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব হুইল চেয়ার ক্রিকেট এর সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশের সন্তান মহসিন।
শারীরিক প্রতিবন্ধিতা জয় করা অসম্ভব কিছু নয়। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝাস্বরূপ কোন গোষ্ঠীও নয়। সুযোগ পেলে তারাও সমাজের আর দশটা মানুষের মতো দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারে। তা হোক কর্মক্ষেত্রে কিংবা ক্রীড়াঙ্গনে। প্রমাণ দিয়েছেন মহসিন।
ব্যক্তিজীবনে দুই কন্যাসন্তানের জনক খেলার পাশাপাশি বাবার ঠিকাদারি ব্যবসারও দেখাশোনা করেন। অনেকেই জানেন না, শুধু ক্রিকেট নয়, মহসিন ভালো ব্যাডমিন্টনও খেলেন! ২০১৯-এ অনুষ্ঠিত প্রথম প্যারা ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে তিনি রানারআপ হন।
মহসিনের স্বপ্ন তার দল একদিন বিশ্বজয় করবে। মহসিনদের সে স্বপ্নপূরণে আমাদের শুভকামনা-ই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন আন্তরিকতা, সাহায্য করার মানসিকতা।