শৈশব–কৈশোর কেটেছে একসঙ্গে। মেতে ছিলেন আড্ডা, খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তাঁদের কেউ কেউ বন্ধু, আবার কেউ বয়সে বড়। এখন তাঁদের কারও বয়স ৭৫, কারও ৮০। আবার কারও ৯০ ছুঁই ছুঁই। কালেভদ্রে দেখা হলেও আড্ডা খুব একটা হয়ে ওঠে না।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) ঠাকুরগাঁও শহরের জগন্নাথপুর এলাকার হাওলাদার হিমাগার চত্বরে এমন সব মানুষের মিলনমেলা বসেছিল। তাদের সময় কাটে হাসি, ঠাট্টা, গান আর আড্ডায়। তারা যেন ফিরে যান সেই শৈশব-কৈশোরে। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সকাল সাড়ে ১০টা। কুয়াশার আড়মোড়া ভেঙে সূর্য তখন উঁকি দিচ্ছে। এমন সময় আসতে শুরু করেন ঠাকুরগাঁও শহরের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা। তাঁদের কেউ আসেন নিজে নিজে, কেউবা অন্যের হাত ধরে। তাঁদের অভ্যর্থনা জানান মির্জা ফখরুল। এক এক করে আসেন তাঁর বন্ধু অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে, আনিসুল হক চৌধুরী, আফিজুর রহমান, ইউনুস আলী চৌধুরীসহ কয়েকজন। এরপর আসেন বলরাম গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক চৌধুরী মো. হুমায়ুন, বিশ্বনাথ দে ধারাসহ অনেকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে জমে ওঠে আড্ডা। উঠে আসে শৈশব, কৈশোর আর তরুণ সময়ের কথা। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলে গরম চা আর শীতের পিঠা খাওয়ার ধুম। প্রিয় মানুষকে পেয়ে কেউ কেউ জড়িয়ে ধরছেন। মুঠোফোনে সেলফি তুলে স্মৃতি ধরে রাখছেন। কোনো কোনো আড্ডার স্থান থেকে ভেসে আসছিল, ‘পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়…।’ বিকেলে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আয়োজনের সমাপ্তি হয়।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বললেন, ‘আমার বন্ধু গোফরানের সঙ্গে খুব দুষ্টুমি করতাম। সে প্রায় রেগে গিয়ে রুস্তম আলী হেড স্যারকে নালিশ করত। হেড স্যার আমাদের ডেকে পাঠান। আমাদের লাইন করে দাঁড় করালেন। আমাদের শাস্তি জুটল একটা করে বেত। সব শেষে ছিল আফিজুর। তাঁর মুখে সব সময় হাসি থাকত। হেড স্যার তাকে বেত মারার পর সে হাসল। হেড স্যার রেগে গিয়ে আবার মারলেন। এর পরও আফিজুর হাসছে। হেড স্যার আরও রেগে গিয়ে ওকে প্রচণ্ড মারলেন। এরপর বেত ফেলে দিয়ে আফিজুরকে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন স্যার।’
মির্জা ফখরুলের এই স্মৃতি শুনে গোফরান আর আফিজুর রহমান হাসতে হাসতে ফেটে পড়লেন। এরপর বলরাম গুহঠাকুরতার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন ফখরুল। দুপুর ১২টার দিকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শহরের নিক্বণ সংগীত বিদ্যালয়ের শিল্পীদের আয়োজনে পরিবেশিত হয় নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, ভাওয়াইয়া ও গজল। পিয়াল বোসের সেতারের সুর বিমোহিত করে সবাইকে।
আড্ডায় কবিতা আবৃত্তি করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার এক ফাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা আবৃত্তি করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘যাঁদের কোলে বেড়ে উঠেছি, যাঁদের সঙ্গে শৈশব কেটেছে, যাঁদের পাশে নিয়ে চলেছি, তাঁদের কেউ কেউ নেই। আবার কেউ কেউ আছেন। যাঁরা আছি এখনো, তাঁরা একটু বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। এই বাঁচাটা হচ্ছে নিজেকে অনুভব করা যে আমি আছি। বলুদার (বলরাম গুহঠাকুরতা) কাছে কয়েক দিন আগে আমি ছিলাম। দেখি, বলুদা প্রায় মরেই যাচ্ছেন। সে একেবারে ঘর থেকে বের হন না। তিনি বলেন, তুমি এভাবে ছোটাছুটি করো কীভাবে? আমি বললাম, দাদা আপনিও পারবেন। আপনি বাতাসে আসেন, সূর্য দেখেন। দেখবেন, আপনিও পারবেন। বলুদার মতো মানুষগুলোকে ঘর থেকে বের করে আনতেই এ আয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘সেই শৈশব আর স্কুলজীবনের কথাগুলো আমি কখনোই ভুলতে পারি না। আমার সব সময় মনে হয়, আমি যদি সেই দিনগুলো ফিরে পেতাম। আজ মনে হচ্ছে, আমি সেই দিনে ফিরে গেছি।’
মিলনমেলায় এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক বিশ্বনাথ দে ধারা। তিনি বলেন, ‘প্রায়ই অসুস্থ থাকি। ঘর থেকে বের হতে পারি না। তবুও এখানে চলে এলাম। এখানে এসে একটা ভালো সময় কাটালাম। এখন মনে হচ্ছে, আমার বয়স ২০ বছর কমে গেছে।’
জেলার সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা জালাল উদদীন বলেন, ‘এটা একটা বিরল সুযোগ। এখানে এসে অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। তাঁদের শহরে দেখতাম। দেখতে দেখতে বড় হয়েছি; কিন্তু এখন দেখা মেলে না। এখানে দেখা হলো, হাত মেলালাম, বুক মেলালাম। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এটা বহু দিন স্মরণে থাকবে।’
প্রবীণ আইনজীবী বলরাম গুহঠাকুরতা বললেন, ‘এই আয়োজনে না এলে বড় একটা জিনিস মিস করতাম। আমার হারানো দিনগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সত্যিই কৃতজ্ঞতা জানাই।’
অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বললেন, ‘মিলনটা যে কত আনন্দদায়ক, এখানে এসে বুঝলাম। অনেকের সঙ্গে দেখা হয় না, এ উপলক্ষে দেখা হলো। এই দেখার মধ্য দিয়ে বাঁচা। আর একটু বেশি বেঁচে থাকার রসদ পেলাম।’
অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বললেন, ‘আজ আমি জীবনীশক্তি ফিরে পেলাম। আমার শৈশব-কৈশোর, স্কুল ও কর্মজীবনের সহযোগী অনেকের সঙ্গে আজ আড্ডা দিলাম। মনে হলো নতুন জীবন ফিরে পেলাম। এ দিনটির কথা বহু দিন মনে থাকবে।’