সড়কে আরও বেপরোয়া অটোচালক: অনিয়মকেই নিয়ম বানিয়ে নৈরাজ্য

রাজধানীতে মাসখানেক আগেও কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠতে গেলে ভাড়ার চুক্তি হওয়ার পরও মিটার অন করে রাখা হতো। গাড়ি ছাড়ার সময় যাত্রীকে চালক বলে রাখতেন- ট্রাফিক ধরলে যেন বলেন মিটারে চলছে। কয়েক বছর ধরে মিটারে না চললেও ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটু চক্ষুলজ্জা থাকত। কিন্তু সম্প্রতি চালকদের আন্দোলনের মুখে মিটারে ভাড়া নেওয়ার পদ্ধতি বাতিল করা হয়। এখন ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও বেপরোয়া অটোরিকশার চালকরা।

আগে নীরবে কাটলেও এখন তারা অনেকটা প্রকাশ্যেই পকেট কাটছে সাধারণ যাত্রীদের। বছরের পর বছর ধরে যাত্রীদের জিম্মি করে পকেট কাটতে থাকেন অটোরিকশার চালকরা। আর এই অনিয়মকেই নিয়ম বানিয়ে চলছে নৈরাজ্য।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীতে প্রাইভেট যাতায়াতের জন্য অন্যতম নির্ভরযোগ্য বাহন হিসেবে প্রচলিত সিএনজিচালিত অটোরিকশা।

নিয়ম অনুযায়ী প্রথম দুই কিলোমিটার ৪০ টাকা করে এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা ও যানজটে প্রতি মিনিট দুই টাকা করে নেওয়ার কথা ছিল। এই পদ্ধতি চালুর কয়েক বছর পরেই তা অমান্য করতে থাকেন চালকরা। মিটার থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে যাত্রীদের বাধ্য করেন চুক্তিতে ভাড়া দিতে। ফলে যেকোনো দূরত্বে যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি সিএনজি বা পেট্রলচালিত অটোরিকশার চালক মিটারের বেশি ভাড়া আদায় করলে তার বিরুদ্ধে মামলা দিতে পুলিশকে নির্দেশনা দেয় সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সড়ক পরিবহন আইনে ভাড়াসংক্রান্ত অপরাধে চালকের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করারও বিধান রাখা হয়। বিআরটিএর পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের সই করা এক চিঠি বলা হয়েছে, গ্যাস বা পেট্রলচালিত ফোর-স্ট্রোক থ্রি-হুইলার অটোরিকশার জন্য বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত মিটারের ভাড়ার হারের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে মামলা রুজু করার নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮–এর ধারা ৩৫(৩) অনুযায়ী কোনো কন্ট্রাক্ট ক্যারিজের মালিক বা চালক রুট পারমিট এলাকার মধ্যে যেকোনো গন্তব্যে যেতে বাধ্য থাকবেন এবং মিটারে প্রদর্শিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ দাবি বা আদায় করতে পারবেন না। এর ব্যত্যয় হলে আইনের ধারা ৮১ অনুযায়ী অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে।

কিন্তু এর প্রতিবাদে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আন্দোলনে নামে চালকরা। ওইদিন ধর্মঘটের ডাক দিয়ে রামপুরা ও রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের সামনে অবস্থান নেন  অটোরিকশা চালকরা। তাদের আন্দোলনের মুখে মামলা ও জরিমানার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় বিআরটিএ। সেদিন থেকেই ভাড়া নির্ধারণে বেপরোয়া ভাব দেখা যায়   চালকদের। আর মিটারও অন করতে দেখা যায় না।

রাজধানীতে নিয়মিত সিএনজিতে চলাচলকারী যাত্রী রাসেদ বলেন, ‘আমি কয়েক বছর ধইরা সিএনজিতে চলাচল করি। ৪-৫ বছর আগে মিটারের থেইকা ২০-৩০ টাকা বাড়াই দিলেই তারা যাইতে রাজি হতো। অহন সামান্য একটু রাস্তা গেলেও আড়াই-তিনশ টাকা ভাড়া চায়া বসে। জরুরি কাজ থাকায় অনেক সময় বাধ্য হয়েই যাইতে হয়।’

ইয়াসির নামে মালিবাগের আরেক যাত্রী বলেন, ‘আগে মালিবাগ থেইকা গুলিস্তান দেড়শ টাকায় নিয়া যাইত। অহন এটুক রাস্তাই আড়াই-তিনশ টাকা ভাড়া চায়। মিটারে যাওয়া তো দূরের কথা, কয়দিন আগে সিএনজিতে উঠলে মিটার অন কইরা দিত অহন তাও দেয় না।’

তবে দায় যে শুধু চালকদের সেটাও বলা যাবে না। আগের থেকে তাদের জমা খরচ বেড়েছে কয়েক গুন। কারওয়ান বাজারের চালক রাসেল বলেন, ‘আমাগেরে মালিককে জমা দিতে হয় ১২০০ টাকা, গ্যাস খরচা আছে ৪০০ টাকা, আরো টুকিটাকি খরচ আছে। ১৮০০-২০০০ টাকা খরচ আমরা তুলম ক্যামনে। তাই বাধ্য হয়েই ভাড়া বেশি নিতে হয়।’ পল্টন এলাকার আরেক সিএনজি চালক বলেন, ‘এখন জিনিস পত্রের যে দাম সংসার চালানোই মুশকিল। তারওপর জমা-খরচাও বাড়ছে। আগ যেই যেইহানে দুই-আড়াই শ টাকা গ্যাস নিলেই হইত অহন সেই গ্যাস কিনতে হয় ৪০০ টাকায়। তারওপর অনেক প্যাসেঞ্জার উবার-পাঠাওয়ে চলাচল করে। কিছু বেশি না নিলে ক্যামনে চলি বলেন।’

জানা যায়, রাজধানীতে ২০০২ সালের শেষ দিক থেকে অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। সেসময় সরকার নির্ধারিত কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বাড়িয়ে ৭ টাকা ৬৪ পয়সা এবং বিরতিকালীন চার্জ ১ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়। সবশেষ ২০১৫ সালে ভাড়া ও জমা বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালে সিএনজির জমা ৯০০ টাকা। বাড়ানো হয় ভাড়াও। তবে কোনো সিএনজি অটোরিকশা চালকরা সরকার নির্ধারিত ভাড়া মানেন না। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি এক জরিপে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত অটোরিকশার ৯৮ শতাংশই ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি নেয়। যাত্রীরাও অটোরিকশার মিটারে না চলাচলের বিষয়টিকে সাধারণ নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এটা দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। এখানে সিএনজি অটোরিকশা মালিকদের জমা খরচ বেশি হওয়ার কারণে এর প্রভাবটা ধীরে ধীরে আমাদের সাধারণ যাত্রীদের ওপর পড়ছে। সরকার যখন বসে তখন শুধু মালিক পক্ষের সাথেই বসে। সেখানে চালক যাত্রীদের কোনো স্টেক হোল্ডার থাকে না। আমি মনে করি- মালিকপক্ষ, চালক, যাত্রীদের প্রতিনিধি সবাই মিলে বসে এর একটা সমাধানে আসা উচিত।’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.