সোনালি যুগের শেষ প্রান্তে `শিল্পপতিদের আঁতুড়ঘর’
সোনালি যুগের শেষ প্রান্তে এসে দাড়িয়েছে দেশে ভোগ্যপণ্যের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র খাতুনগঞ্জ; যা শিল্পপতিদের আঁতুড়ঘর হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে। এখানে আগের মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেই; লেনদেন বাড়লেও কমেছে প্রতিযোগিতা। আবার প্রতারণার নতুন পদ্ধতিতে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে জৌলুস হারাতে বসেছে একবিংশ শতকের শুরুতে গড়ে ওঠা এই বাণিজ্যকেন্দ্রটি।
জানা গেছে, ইংরেজ আমলের মতো পাকিস্তান আমলেও খাতুনগঞ্জ ছিল এ অঞ্চলের পণ্য বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে পণ্য বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জ থেকেই। সে সময় অবাঙালিদের হাতে ছিল বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ। বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের আমদানি পণ্যের বিক্রেতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে বাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে আসে বাণিজ্য। সোনালি দিনের শুরুটাও স্বাধীনতার পর।
খাতুনগঞ্জকে কেন্দ্র করে আশপাশে অনেক পণ্য বাজার গড়ে উঠেছে। চাক্তাই, আসাদগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ ঘিরে পুরো এলাকা এখন খাতুনগঞ্জ নামেই পরিচিত। এ এলাকার প্রায় পাঁচ হাজারের মতো আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি ঢেউটিনসহ ইস্পাত পণ্য, রাসায়নিক ও নিত্যব্যবহার্য পণ্য বেচাকেনা হয় খাতুনগঞ্জে।
একসময় দেশে উৎপাদিত পণ্যই বেশি বেচাকেনা হতো খাতুনগঞ্জে। ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশক থেকে আমদানিনির্ভর হতে থাকে নিত্যপণ্য। দেশে উৎপাদিত পণ্যের পাশাপাশি আমদানিনির্ভর পণ্যও বেচাকেনা শুরু হয় খাতুনগঞ্জে।
এই বাজারে সকাল শুরু হতো টি কে, আবুল খায়ের, এমইবি, মোস্তফা, এসএ, এনজিএসের মতো ১২টি গ্রুপের তুমুল প্রতিযোগিতা। এসব প্রতিষ্ঠানের সয়াবিন-পামতেল বিক্রির কাগজ বা ডিও (চাহিদাপত্র) হাতবদলে। সড়কে-দোকানের সামনে থাকত ব্রোকারদের জটলা। শেয়ারবাজারের মতো অস্থিরতা, উত্তেজনা, দরপতন, ঊর্ধ্বগতি—এসব অনুষঙ্গের কোনো কমতি ছিল না। সয়াবিন ও পামতেলের মতো সরগরম ছিল চিনি, গম, ডাল কিংবা মসলার বেচাকেনাতেও।
তবে মাত্র দুই দশক পেরিয়ে এখন খাতুনগঞ্জে এমন হাঁকডাক নেই। সে সময়ের বড় গ্রুপগুলোর অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছে। গুগলে অনুসন্ধান বাটনে ক্লিক করে কারও নাম পাওয়া যায় আদালতের শুনানির কার্যতালিকায়। কেউবা ব্যবসা পরিবর্তন করে অন্য শিল্পে সরব হয়েছে। কমেছে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। সেই জায়গা নিয়েছে ঢাকার গুটিকয়েক বড় শিল্পগ্রুপ। একসময় যে খাতুনগঞ্জ থেকে বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের বাণিজ্যের উত্থান হয়েছিল, তা এখন ম্রিয়মাণ।
জানা গেছে, ৪০ বছরে এক হাজার কোটি বেশি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন শতাধিক ব্যবসায়ী। এতে যেমন বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছে, তেমনি মূলধন হারিয়ে পথের ফকির হচ্ছেন প্রতারণার শিকার সাধারণ ব্যবসায়ীরা। এক থেকে ১০ কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেয়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা অন্তত ৭০ জন বলে জানিয়েছেন প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ীরা।
এক সময়ের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন সাহা এখন রাস্তার পাশের ব্রোকার। পণ্য বিক্রির পাওনা ১৫ কোটি টাকা ফেরত না পেলেও ৯ কোটির টাকা দেনা শোধ করতে হয়েছে নিজের মালিকানাধীন বহুতল ভবন বিক্রি করে।
প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন সাহা বলেন, ‘বিল্ডিং বিক্রি করে ৯ কোটি টাকা দেনা শোধ করেছি। কিন্তু আমি লাইন থেকে ১৫ কোটি টাকার এক টাকাও ফেরত পাইনি। আমাকে এখন পথের ফকির হিসেবে ধরা যায়। আমি এখন ব্রোকারি করে চলছি।’
দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ভোগ্য পণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে মনোরঞ্জন একা নয়, তার মতো শত শত ব্যবসায়ী প্রতারকদের কাছে টাকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। মূলত কম সময়ে বেশি লাভের আশায় কথিত ডিও এবং স্লিপ ব্যবসায়ীর কবলে পড়ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ভোজ্য তেল-চিনি এবং মসলা বেচা-কেনার ক্ষেত্রে ডিও ব্যবসা বেশি হওয়ায় এগুলোতে প্রতারণাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
চট্টগ্রাম জেলার খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী জাফর আহমেদ বলেন, ‘বাজারে দেড় কোটি টাকার পণ্য বাকিতে দিচ্ছে, পরে দেখা যায়, বাজার দর কমে গেছে, পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। তাহলে যিনি দেড় কোটি টাকা দিয়ে বাকিতে পণ্য কিনেছেন, তিনি টাকা দেবেন কি করে? পরে লোকসানে পণ্য বিক্রি করে ওই টাকা শোধ করতে হয়। সেটাও না পারলে সুদের ওপর টাকা নিয়ে ওই দেনা পরিশোধ করতে হয়।’
চট্টগ্রাম জেলার খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ী আব্বাস আলী বলেন, ‘অসাধু কিছু ব্যবসায়ী আছেন; তাদের উদ্দেশ্য ব্যবসা না, মানুষের বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রতারণা করা।’
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালে বিভূতি রায় নামে এক ব্যবসায়ী ৬ কোটি টাকা নিয়ে পালানোর পর থেকে শুরু হয় প্রতারণার নতুন এই পদ্ধতি। সবশেষ ৫০ কোটি টাকার বেশি নিয়ে লাপাত্তা নূর ট্রেডিং নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। অবশ্য এরআগে চৌধুরী ব্রাদার্স ১৪৮ কোটি, মৌলভী আলম কোটি, শাহ জামাল ৫০ কোটি, মোহাম্মদ আলী ৪৭ কোটি, শাহজাহান ট্রেডার্স ২৪ কোটি, আবসার-মুছা ব্রাদার্স ২১ কোটি, নুরুল আলম চৌধুরী ২০ কোটি এবং এম রহমান ১২ কোটি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার কল্যাণ সমিতি সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, যারা ডিও ব্যবসা করেন তাদের কোনো মালামাল দেখা যাচ্ছে না। তারা শুধু স্লিপের মাধ্যমে কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন করছেন। এটার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
খাতুনগঞ্জ মেসার্স আলতাফ অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক মুহাম্মদ আলতাফ এ গাফ্ফার বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রথম দিকে নগদে লেনদেন করেন। বিশ্বস্ততা অর্জন করে পরে তারা বাকিতে নেওয়া শুরু করেন। এরা আসলে পাতানো ব্যবসা করে প্রতারণা করেন।’
ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই-আছাদগঞ্জ এবং খাতুনগঞ্জে ৫ হাজারের বেশি ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পণ্য রাখার গুদাম রয়েছে। এখানে সবগুলো সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা থাকলেও নিজেদের মধ্যে নগদ টাকা লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ব্যবসায়ীরা। আবার ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে টাকা আদায়ের চেষ্টা করায় ভুক্তভোগীরা অনেকক্ষেত্রে মামলা করতে আগ্রহী নন বলে জানায় পুলিশ।
সিএমপির উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের নিজেদের যে সমস্যাগুলো হয়, সেগুলো তারা নিজেরাই সমাধান করেন। তারা পুলিশের কাছে আসেন না। যদি কোনো বাদী আমাদের কাছে আসেন তাহলে অবশ্যই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার কল্যাণ সমিতি সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ যাবৎ অনেকে প্রতারণা শিকার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত কারও কোনো বিচার হয়নি। আমার নিজেরও অনেক মামলা আছে, রায়ও হয়েছে; কিন্তু টাকা পাচ্ছি না।’