সূর্যমুখীতে স্বপ্ন বুনছেন কিশোরগঞ্জের কৃষকরারা
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রাম। রোপা আমন ধান কাটার পর জমিগুলো এক রকম পতিত হিসেবেই পড়ে থাকে। এরপর সেখানে দীর্ঘ সময় পর করা হয় পাট চাষ। মধ্যবর্তী সময়ে জমিগুলো পতিত না রেখে কি কাজে লাগানো যায়, সেই নিয়েই কৃষকরা ছিলেন চিন্তিত। কিন্তু কৃষি বিভাগের পরামর্শে সেই চিন্তার ভাঁজ কমেছে তাদের। পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষে কৃষকরা নতুন স্বপ্নের সূচনা করেছেন।
গ্রামে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে সূর্যমুখীর আবাদ চোখে পড়ার মতো। চৈত্রের শুরুতেও যেন বসন্তের হাওয়া বইছে চারপাশে। নীল আকাশের সঙ্গে হলুদ এই ফুলের সৌন্দর্য যে কারো মনে দোলা দিয়ে যায়। এখন রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয়, সকালের সোনা রোদে পাপড়ি মেলেছে সূর্যমুখী। তাইতো সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসছেন।
সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সকাল বেলা পূর্বদিকে তাকিয়ে থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের সঙ্গে ঘুরতে থাকে। সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সূর্যমুখী ফুলগুলোও তাকিয়ে থাকার দৃশ্য সবাইকে আকৃষ্ট করে।
তাছাড়া সরিষা এবং সোয়াবিনের চেয়ে সূর্যমুখীর তেল গুণে-মানে অনেক এগিয়ে। বাজারে যেমন রয়েছে এর চাহিদা, তেমনই রয়েছে বাজার মূল্যমানও। ফুল থেকে উৎপন্ন বীজও খুব ভালো বিক্রি হয় বাজারে। অন্যদিকে এ গ্রামে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক চাষ আর বাম্পার ফলন হওয়ার অন্যান্য কৃষকরাও আগ্রহী হয়েছেন। আগামীতে তারাও সূর্যমুখীর চাষ করতে চান।
সদর উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, মাইজপাড়া গ্রামে দুই একর জমিতে কৃষক সেলিম সরকারসহ চারজন সূর্যমুখী চাষ করেছেন। মহিনন্দ ইউনিয়নে এবারই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। রোপা আমন কাটার পর প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হেক্টর জমি পতিত পড়ে থাকে। সেখানে কিছুই আবাদ করতেন না কৃষকরা। রোপা আমনের পর এই জমিগুলোতে পাট চাষ করতো। তাই মধ্যবর্তী সময়ে পরীক্ষামূলকভাবে সূর্যমুখী চাষটি করা হয়েছে। দেশি ঘানি ব্যবহার করলে পরিপক্ক সূর্যমুখী ফুলের বীজ থেকে তেল সংগ্রহ করা যায়। এই তেলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও কম। তাই সূর্যমুখী ফুল চাষে কৃষককের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিস।
কৃষক সেলিম সরকার জানান, ‘আমি এইবারই প্রতথম (প্রথম) জমিতে সূর্যমুখীর ফলন ফলাইছি। সরকারি বীজ ও সার আমি মাগনাই (বিনামূল্যে) পাইছি। ফুলডা দেখতেও সুন্দর আর খুবই বাম্পাইরা ফলন হইছে। এইডা বাম্পার যে বাম্পারই। চাষে যদি ২০ হাজার টেহা খরচ অয় (হয়)। তাইলে ৬০ থেইক্যা (থেকে) ৭০ হাজার টেহা (টাকা) লাভ করতারবাম। আগামীতে আরও তিনডা ক্ষেত বাড়াইবাম চিন্তা করছি। তাছাড়া আমরার দেহাদেহি অনেকেই অহন সূর্যমুখী ফুলের চাষ করতো ভাবতাছে।’
সেলিমের মতো জহির, বাবু ও কাইয়ুমও সূর্যমুখী এবারই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছেন-মহিনন্দ ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে। তারা জানান, প্রথমদিকে তাদের অনীহা ছিল, এখন অনেক ভালো লাগছে। ফুলগুলো ফোটার পর এলাকায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি অফিসের সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছি। এই ফসলে খুব একটা খরচ হয়নি। অফিস থেকে বীজ ও সার দিয়েছে। তারা শুধু নিড়ানি দিয়ে গাছের পরিচর্যা করেছে। এ ফসলটি তারা আগামীতেও করতে চান।
এদিকে প্রতিদিন বিকেলে শহরসহ আশেপাশের এলাকা থেকে সৌন্দর্য পিয়াসুরা দল বেঁধে আসেন এই সূর্যমুখী ফুলের বাগান দেখতে। অনেকেই বাগানে ঢুকে শখ করে ছবি তুলেন। এ যেন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।
রাকিবুল হাসান এসেছিলেন তার পরিবার নিয়ে। তিনি বলেন, অপূর্ব এক অনুভূতি। গত কয়েকদিন আগে এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনই সূর্যমুখী বাগানটি চোখে পড়ে। আর তখনই ভেবেছি এখানে পরিবার নিয়ে একবার ঘুরতে আসব। ফসলের মাঝে সূর্যমুখী ফুলের এমন বাগান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা কৃষকদের জন্য খুবই ভালো। তবে যারা দেখতে আসছেন সবাইকে তিনি ফুল ছেড়া বা চাষীর যেন কোন ক্ষতি না হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখার অনুরোধ করেছেন। পাশাপাশি পতিত জমি ফেলে না রেখে সূর্যমুখী ফুলচাষে কৃষকদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
ধান চাষী মো. আব্দুল কালাম জানান, ‘এলাকার চাইরজন (চারজন) কৃষি অফিসের কতায় দুই একর জমিত সূর্যমুখীর বাগান করছে। এমুন বাগান দেইখ্যা আমরাও ভাবতাছি আগামীতে এই চাষ করুম। আমরাও তো অনেক জমি পতিত পইড়া রইছে। অল্প সময়ে এর ফলনও বালা হয় আর লাভও নাকি বালাই হয়। তাই আগামীতে কৃষি অফিসে কতা কইয়া আমরাও এই চাষ করবাম ভাবতাছি।’
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাসিরুজ্জামান সুমন বলেন, মহিনন্দ ইউনিয়নে আমরা এবারই প্রথম সূর্যমুখী চাষ শুরু করেছি। এ বছর দুই একর পতিত জমিতে সূর্যমুখী চাষ করা হয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে পরীক্ষামূলকভাবে সূর্যমুখী চাষটি করতে বলেছি। এখন কৃষকদের মাঝে একটি আশার আলো সঞ্চার হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এই পতিত জমিগুলোকে চাষাবাদের আওতায় আনা। এখন চাষিদের মধ্যে আগ্রহ জন্মেছে। তাছাড়া সূর্যমুখী অত্যন্ত লাভজনক তেলজাতীয় ফসল। কৃষকরা সরিষা আবাদে যেমন লাভবান হয়, সূর্যমুখীতে তার চেয়ে বেশি লাভবান হবে। আশা করি, আগামীতে সূর্যমুখীর আবাদ অনেক বৃদ্ধি পাবে।