সীমান্তে বাংলাদেশিদের ভরসা ভারতীয় সিম!
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা-আখাউড়া ও বিজয়নগরসহ তিন উপজেলার গ্রামগুলোতে অবাধে ব্যবহার করা হচ্ছে ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল সিমকার্ড। এতে সীমান্তে চোরাচালান বৃদ্ধিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে।
এছাড়া অবাধে ভারতীয় মোবাইল সিমের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার। এমন অবস্থায়ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অনেকটা নীরব।
জানা গেছে, কসবা উপজেলার, গোপিনাথপুর, ধজনগর, বায়েক, কোল্লাপাথর, মাদলা, খাদলা, বেলতলী পুটিয়া ও আখাউড়া উপজেলার, সীমান্তবর্তী উত্তর ইউনিয়নের, আজমপুর, রাজাপুর, আমোদাবাদ, কল্যাণপুর ও আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের, বঙ্গেরচর, কালিকাপুর, সেনারবাদী, বাউতলা, গাজীর বাজার, উমেদপুর, মনিয়নন্দ ইউনিয়নের তুলাই শিমুল, কর্মমঠ, গঙ্গাসাগর, শিবনগর ও ঘাগুটিয়া এবং বিজয়নগর উপজেলার সিংগার বিল, মেরাসানী, কাশিনগর, বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, আওলিয়া বাজার, ছতুরপুর, পাহারপুর, হরষপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে ভারতীয় সিমকার্ডে চলে ইন্টারনেটভিত্তিক সব কার্যক্রম। স্থানীয়দের তথ্যমতে, সীমান্তবর্তী কসবা, আখাউড়া ও বিজয়নগরের ৭৩ কিলোমিটার অংশে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক ভারতীয় মোবাইল সিম ব্যবহার হচ্ছে।
সীমান্তবর্তী অঞ্চলের গ্রাম ও বাজারগুলোতে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা স্মার্টফোন নিয়ে তরুণদের গল্প, আড্ডা বেশ জমজমাট থাকে। আড্ডাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, তাদের মোবাইলফোনে বাংলাদেশি কোনো সিমকার্ড নেই। তরুণরা মোবাইলভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা না পেয়ে ভারতীয় সিমকার্ড যেন তাদের কাছে শেষ ভরসা।
কসবা সীমান্ত অঞ্চল ঘুরে পুটিয়া সীমান্তবর্তী খাদলা বাজারে দেখা মেলে একদল তরুণের। তারা গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ ইন্টারনেটভিত্তিক ফ্রি-ফায়ার, পাবজির মতো গেমও খেলছেন ভারতীয় সিম ব্যবহার করে।
স্থানীয় সচেতন গ্রামবাসী জানায়, ভারতীয় সিমের অবাধ ব্যবহারের কারণে সীমান্তের ওপারে ভারতীয় চোরাকারবারিদের সঙ্গে বাংলাদেশের চোরাকারবারি ও মানবপাচারকারীরা মোবাইলে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন একাধিক চক্র। চালাচ্ছেন মাদক পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এতে করে সীমান্ত অঞ্চলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
তবে ভারতীয় মোবাইল সিমকার্ড ব্যবহারকারী বাংলাদেশি নাগরিকরা জানান, বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক না থাকায়, তারা বাধ্য হয়েই ভারতীয় সিমকার্ড ব্যবহার করছেন।
কসবা পুটিয়া সিমান্তবর্তী গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা মো. আরমান বলেন, ‘আমাদের এই এলাকার খাদলা, মাদলা, পুটিয়া, বেলতলী এসব এলাকায় বাংলাদেশি নেটওয়ার্কের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। যার কারণে আমরা আমাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি না। তাই আমরা বাধ্য হয়ে ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানির সিমকার্ড ব্যবহার করছি। এই সিমকার্ড ব্যবহার করলে, আবার বিজিবিও আমাদের মাঝে মধ্যে হয়রানি করেন। বর্তমান সরকার যদি আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে মোবাইল নেটওর্য়াকের ব্যবস্থা করে দিতেন, তাহলে আমরা অনেটা উপকৃত হতাম।’
সীমান্তের বাসিন্দা ইকবাল মিয়া বলেন, ‘আমাদের এই এলাকার আশপাশে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি বা অন্য কোনো সিমকার্ডের নেট পাওয়া যায় না। তাই আমরা ইন্ডিয়ান এয়ারটেল, জিও, ভোডা এই সিমগুলো চালাই। আমাদের এই গ্রামের মধ্যে কোনো সিমের টাওয়ার নাই। আমরা যদি বাংলাদেশের নেট পেতাম তাহলে আমরা ভারতের সিম ব্যবহার করতাম না। আমাদের দাবি এই এলাকায় যেন বাংলাদেশি মোবাইল নেটওর্য়াক দেয়া হয়।’
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি আব্দুন নূর বলেন, ‘আখাউড়া ,কসবা, বিজয়নগর এলাকার সীমান্ত অঞ্চলে ভারতীয় নেটওয়ার্ক চালু থাকার ফলে এলাকার লোকজন ভারতের সিম ব্যবহার করছেন। সেজন্য এসব এলাকার অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। তাছাড়া এসব এলাকায় অপরাধ হলে আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের শনাক্ত করতে পারছে না। এই সুযোগে সীমান্তে চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপকর্ম বেড়েই চলেছে। ভারতের সিম ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের মোবাইল ভিত্তিক রাজস্ব অনেকটাই কমছে।
তিনি বলেন, ‘জনস্বার্থে আমি দাবি জানাবো যে, এসব এলাকায় আমাদের দেশীয় মোবাইল সিম কোম্পানির মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন করার জন্য। এতে অপরাধ প্রবণতা কমে আসার পাশাপাশি দেশের রাজস্বও বাড়বে।’
এ ব্যাপারে বিজিবি ৬০ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছি। আমাদের দেশের যে সিম অপারেটর আছে তাদের বলেছি, এই এলাকায় তাদের নেটওয়ার্ক উন্নত করার জন্য। যাতে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের অন্য দেশের সিমকার্ড ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। তারা পরিকল্পনা করছে নেটওয়ার্ক আরও উন্নত করার জন্য।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘আমরা বিষয়টি শুনেছি। আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে, সেখানকার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই ভারতের সিম ব্যবহার করছে। সেখানে রাজস্বেরও একটা বিষয় আছে। তাছাড়া আরও বড় সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের শনাক্ত করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা অবনতির একটি বিষয় আছে। যার কারণে চোরাচালান বেড়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমরা বিটিআরসির সঙ্গে কথা বলে এই ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’