সারা দুনিয়ায় সাড়া জাগানো ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’। কি ছিল সেই ভাষণে?
বিখ্যাত আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমেরিকায় নাগরিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে
কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
মার্টিন লুথার কিং-ই প্রথম মানুষ, যিনি আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো মানুষদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ বা সাদাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে প্রায় তিন লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কিং তার বিশ্ববিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ বা ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ভাষণটি প্রদান করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম । ওয়াশিংটন অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচীতে তিনি ভাষণটি প্রদান করেন। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী যুবক জেমস আর্ল রে নামক আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মার্টিন মৃত্যুবরণ করেন।
মাল্টিনিউজটোয়েন্টিফোর পাঠকদের জন্য তার সেই বিখ্যাত ভাষণটির হুবহু অনুবাদ প্রকাশ করা হলোঃ
“আমি আজ আপনাদের সাথে এমন এক সমাবেশে মিলিত হতে পেরে অনেক খুশি-যা মুক্তিকামী মানুষের বৃহত্তম মিছিল হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।
পাঁচ কুড়ি (১০০) বছর আগে একজন মহৎ আমেরিকান-যার প্রতীকী ছায়ার নিচে আজ আমরা দাঁড়িয়ে , তিনি মুক্তির সনদ এঁকেছিলেন। তিনি এমন এক অধ্যাদেশ দিয়েছিলেন যা অন্যায়-অবিচারের আগুনে দগ্ধ হওয়া লক্ষ লক্ষ নিগ্রো কৃতদাসের কাছে আশার বাতিঘর হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছিল। এটা ছিল তাদের বন্দিত্বের দীঘল রাত্রি শেষে এক হাস্যোজ্জ্বল ভোরের আলোর মত।
কিন্তু একশ বছর পেরিয়ে গেলো তবু কালোরা আজও মুক্তি পেলো না। একশ বছর পরেও বৈষম্য আর বিচ্ছিন্নকরণের চক্রে পড়ে নিগ্রোদের জীবন পঙ্গু হয়ে আছে। একশ বছর পরেও আমেরিকার উন্নয়নের অথৈ মহাসাগরের মাঝে নিগ্রোরা বাস করে ক্ষুধার নির্জন দ্বীপে। একশ বছর পরেও আমেরিকান সমাজের নিভৃত কোণে নিগ্রোরা জরাগ্রস্ত, নিস্তেজ। স্বদেশে থেকেও নির্বাসিত। তাই আমরা এখানে সমবেত হয়েছি একটি লজ্জাজনক পরিস্থিতির নাটক মঞ্চায়ন করতে।
এক হিসাবে আমরা আমাদের জাতির ‘ব্যাংকের চেক’ এ পরিণত হয়েছি যা ভাঙিয়ে ক্যাশ করা যায়! আমাদের প্রজাতন্ত্রের রূপকারগণ যখন আমাদের সংবিধান এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে পবিত্র শব্দচয়ন করেছিলেন, তখন তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে এর উত্তরাধিকারী হবেন প্রতিটি আমেরিকান। এ সনদ ছিল এমন একটা প্রতিজ্ঞা যে, কালো এবং সাদা সকলেই জীবনের অনিবার্য অধিকার, স্বাধীনতা এবং সুখের অন্বেষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্ণবাদ উদ্বেগজনক-এটা আজ পরিষ্কার যে, আমেরিকা তার ওয়াদা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। পবিত্র সংবিধানের বাধ্যবাধকতা মেনে চলার পরিবর্তে আমেরিকা নিগ্রো লোকদের এমন একটা ‘চেক’ দিয়েছে যা ব্যাংকে নিয়ে গেলে তার পেছনে ‘অপর্যাপ্ত ফান্ড’ লিখে ফেরত দেয়া হয়!
কিন্তু আমরা বিশ্বাস করতে চাই না বিচারের আদালত দেউলিয়া! আমরা এটা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করি যে -জাতির বিশাল সুযোগ-সুবিধার ভাণ্ডার অপর্যাপ্ত। এবং তাই আমরা চেক ভাঙ্গাতে এসেছি যা দিয়ে আমরা স্বাধীনতার সৌন্দর্য এবং ন্যায্য নিরাপত্তার দাবি মেটাবো।
আজকে আমরা এখানে পবিত্র স্থানে উপস্থিত হয়েছি আমেরিকাকে ভয়াবহ গুরুত্ববহ পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দিতে। আমি আপনাদেরকে বলব চুপচাপ বসে থাকা বিলাসিতার সময় এখন নয়। গণতন্ত্রের দাবি বাস্তবায়নের এখনই সময়। এখনই সময় পতিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে বেরিয়ে আসার। এখনই সময় অন্ধকার ভেদ করে জেগে উঠার। এখনই সময় জাতির সুবিচারের পথে আসার। এখনই সময় জাতিগত অবিচারের চোরাবালি থেকে জাতিকে সুদৃঢ় বন্ধনের দিকে টেনে নেবার। এখনই সময় ঈশ্বরের প্রতিটি সন্তানের বাস্তবতা অনুধাবনের।
সময়ের দাবি বুঝতে পারা জাতির জন্য অনেক গুরুত্ববহ। নিগ্রোদের ঘাম ঝরানো এ দাহকাল শেষ হবে না যতক্ষণ না একটা স্বাধীনতা এবং সাম্যের সুবর্ণ হেমন্তের উদয় হবে। উনিশ শত ছেষট্টিই শেষ নয়, কেবল শুরু মাত্র। বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড় জাতির ভীতকে নাড়াতে থাকবে যতদিন না সুবিচারের উজ্জ্বল দিন আসে। একটা কথা আমি আমার লোকদের অবশ্যই বলব, যারা মরণ খেলায় জ্বলন্ত তক্তপোষের উপর দাঁড়ানো-যার শেষ হবে সাম্যের প্রাসাদে। আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমরা কোন অন্যায় কার্যে লিপ্ত হব না। ঘৃণা এবং রক্তের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতার তৃষ্ণা মেটাবো না। আমরা আমাদের সৃজনশীল প্রতিবাদকে সন্ত্রাসী কার্যে পর্যবসিত হতে দেবো না। আমাদেরকে বারবার চেষ্টা করতে হবে দৈহিক শক্তি এবং আত্মিক শক্তির মিশ্রণের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছাতে। চাকচাক্যিময় নতুন শাসন নিগ্রোদের গ্রাস করছে। আমরা যেন প্রত্যেক শেতাঙ্গকেই অবিশ্বাস কিংবা দোষী মনে না করি। এখানে আমাদের পাশে শ্বেতাঙ্গ ভাইদের উপস্থিতিই বলে দেয় যে তাদের লক্ষ্য এবং আমাদের লক্ষ্য একই সুঁতোয় গাঁথা। তারা বিশ্বাস করতে পেরেছে যে তাদের স্বাধীনতা আর আমাদের স্বাধীনতা এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা।
আমরা একাকি এগুতে পারব না। এবং যদি আমরা চলি তবে অবশ্যই সামনে চলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা পেছনে ফিরব না। এখনও কেউ কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করছে আমরা কখন ঘরে ফিরে যাব?
আমরা ঘরে ফিরব না যতদিন পর্যন্ত নিগ্রোরা পুলিশি বর্বরতার শিকার হবে। আমরা কিভাবে নিশ্চুপ থাকি যেখানে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ক্লান্ত হয়ে, আমরা এ শহরের হোটেল এবং মোটেলগুলোতে জায়গা পাই না? আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না যেখানে আমরা ক্রমশ ছোট লাঞ্ছনা থেকে বড়তর লাঞ্ছনার দিকে চলছি। আমরা সন্তুষ্ট হতে পারি না যেখানে আমাদের ব্যক্তিত্ব ধুলোয় মেশে আর আত্মমর্যাদাও হয় ভুলুণ্ঠিত যখন দেখি হোটেলের সাইনবোর্ডে লেখা থাকে, ‘শুধুমাত্র সাদাদের জন্য’। আমরা কিভাবে সহ্য করি যেখানে মিসিসিপির নিগ্রোদের ভোটের অধিকার নেই। না না আমরা সন্তুষ্ট নই, সন্তুষ্ট হতে পারি না যতদিন না বিচারের বাণী জলধারার মত প্রচণ্ড স্রোতে সঠিক পথে গড়িয়ে যাবে।
আমরা বিস্মৃত হইনি যে, এখানে সমবেত অনেকেই বিভিন্ন বিচারের ট্রায়াল এবং ট্রাইব্যুনাল থেকে এসেছেন। কেউ বা সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এবং আপনারা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন যেখানে আপনাদের একমাত্র চাওয়া হচ্ছে স্বাধীনতা, কেননা আপনারা অত্যাচারে জর্জরিত, পুলিশি বর্বরতায় হতবিহ্বল। আপনারা হলেন সৃষ্টিশীল দুর্দিনের বীর সেনানী। আপনারা কাজ চালিয়ে যাবেন এই বিশ্বাসের সাথে যে এ অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্টই আপনাদের মুক্তি এনে দেবে।
আপনারা মিসিসিপি যান। আপনারা এ্যালাবামা যান। আপনারা সাউথ ক্যারোলিনায় যান, জর্জিয়ায় যান, লুইসিয়ানায় যান। আমাদের বস্তিগুলোতে, আমাদের শহরের বঞ্চিত শিবিরগুলোতে যান। জেনে রাখুন এই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হবেই, যে করেই হোক। আজকে আমি আপনাদের বলি, বন্ধুগণ আমরা হতাশার উপত্যকায় নিমজ্জিত হব না এবং এমনকি, যে সকল কষ্ট আমরা স্বীকার করছি আজকে এবং যা আগামীতেও স্বীকার করব।
তারপরও আমার একটা স্বপ্ন আছে। এমন একটা স্বপ্ন যার শিকড় আমেরিকার মূলস্বপ্নে প্রোথিত। বন্ধুগণ, আমার একটা স্বপ্ন ছিল যে, এ জাতি একদিন জেগে উঠবে এবং তার সত্যিকার আদর্শ অনুসরণ করবে। আমরা এই সত্য ধারণ করি যে, পৃথিবীর সব মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
আমার একটা স্বপ্ন ছিল এমন একদিন জর্জিয়ার লালপাহাড়ে কৃতদাসের সন্তানেরা এবং তাদের মালিকেরা একত্রে ভ্রাতৃত্বের টেবিলে বসতে পারবে। আমার একটা স্বপ্ন ছিল—’মিসিসিপি’, যেখানে অন্যায়-অত্যাচারের বিভীষিকা মাত্রা ছাড়িয়েছে, সেটি একদিন স্বাধীনতা আর সুবিচারের নন্দনকাননে পরিণত হবে।
আমার একটা স্বপ্ন ছিল এমন যে -আমার ছোট চার সন্তান এমন এক জাতিতে বাস করবে যেখানে তারা তাদের গাত্রবর্ণ দ্বারা মূল্যায়িত না হয়ে তারা তাদের চারিত্রিক উত্কর্ষ দ্বারা মূল্যায়িত হবে। আজকে আপনাদের কাছে আমি একটা স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছি। আমি একটা স্বপ্ন নিয়ে এসেছি যে একদিন এ্যালাবামায় ছোট ছোট কৃষ্ণাঙ্গ বালক-বালিকারা শ্বেতাঙ্গ বালক-বালিকাদের সাথে হাত মেলাবে। ভাইবোনের মত।
আজকে আমি একটা স্বপ্ন নিয়ে এসেছি। আমার একটা স্বপ্ন আছে যে একদিন প্রতিটি উপত্যকা উন্মুক্ত হবে। প্রতিটি অহংকারী মানুষ বুঝতে পারবে, আমাদের সকল সমস্যা দূর হবে, ভুল বুঝাবুঝি দূর হবে এবং অতি অবশ্যই ‘ঈশ্বরের মাহাত্ম্য’ উন্মোচিত হবে। প্রতিটি রক্ত-মাংসের প্রাণী তা দেখতে পাবে।
এই হলো আমাদের আশা, যা নিয়ে আমি দক্ষিণে ফিরে যাব। এই বিশ্বাসে যে-আমরা হতাশার পর্বত থেকে এক টুকরা আশার পাথর কেটে বের করব। এই বিশ্বাসে যে-আমরা আমাদের জাতির জংলি আচরণকে ভ্রাতৃত্বের ঐকতানে পরিণত করতে পারব। এই বিশ্বাসে যে-আমরা একত্রে কাজ করতে পারব। এই বিশ্বাসে যে আমরা একত্রে প্রার্থনা করতে পারব। এই বিশ্বাসে যে-আমরা একত্রে সংগ্রাম করতে পারব; এমনি কি জেলেও যেতে পারব।
এই বিশ্বাসে আমরা একত্রে স্বাধীনতার জন্য দাঁড়াব এবং জানব যে মুক্তি আমাদের আসবেই। সেই দিন! এবং সেই দিন ঈশ্বরের সকল সন্তান নতুন অর্থে গেয়ে উঠবে…এ আমার দেশ…স্বাধীনতার স্বর্গভূমি। আমি তার গান গাই, প্রতি পাহাড়ের ঢালে ঢালে মুক্তপ্রাণ এইতো চাই। এবং আমেরিকা যদি এক মহান জাতিতে পরিণত হতে চায় আমাদের এ বিশ্বাস অবশ্যই সত্যি হতে হবে। আপনারা স্বাধীনতার সুর বেজে উঠতে দিন নিউহ্যাম্পশায়ারের অতিকায় পাহাড় চূড়া হতে। স্বাধীনতার ঘন্টা বাজুক নিউইয়র্কের শক্তিমান পর্বতে।
স্বাধীনতার ঘন্টা বাজুক সুউচ্চ পেনসিলভেনিয়ার পাহাড়ে। স্বাধীনতার ঘন্টা বাজুক তুষারাচ্ছাদিত কলোরাডোর মাটিতে। স্বাধীনতা জয়ী হোক ক্যালিফোর্নিয়ার ঢালু পথে এবং শুধু তাই নয়-স্বাধীনতার জয় হোক জর্জিয়ার পাথুরে পর্বতে, টেনিসির দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ে, মিসিসিপির প্রতিটি টিলায়। স্বাধীনতার ঘন্টা বাজুক পাহাড়ের প্রতিটি উপত্যকায় এবং যখন এমন হবে আমরা স্বাধীনতার তোপধ্বনি দিব বাড়ি থেকে বাড়িতে, গ্রাম থেকে গ্রামে, উপশহর থেকে উপশহরে। প্রতিটি রাজ্যে। আকাশে। বাতাসে। সেদিন ঈশ্বরের প্রতিটি সন্তান, সাদা-কালো, ইহুদি, প্রোটেস্ট্যান্ট-ক্যাথলিক প্রত্যেকে একত্রে হাত রেখে প্রাচীন নিগ্রোদের প্রাণের সুরে বলব-
অবশেষে আমরা মুক্ত!
অবশেষে আমরা মুক্ত! সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। অবশেষে আমরা মুক্ত!”
(ভাষণটি সংগৃহীত)