সমানতালে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান ও ইসরায়েল
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির এক সাম্প্রতিক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) শীর্ষ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন সংঘাতের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফিং করেন। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক সেনা প্রতিনিধি আইনপ্রণেতাদের জানান, ইরান তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের আশঙ্কা, ১২ দিনের সংঘাতের মতোই ইরান একসঙ্গে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ব্যাপক হামলা চালাতে পারে।
গত এক মাস ধরে পশ্চিমা প্রধান গণমাধ্যমগুলো ইসরায়েল-ইরান সংঘাত ঘিরে ক্রমেই ভয়াবহ পূর্বাভাস দিচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ও স্বাধীন বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। সংবাদমাধ্যমটির মতে, উভয় পক্ষ দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, প্রক্সি ফ্রন্টগুলো বিস্তৃত করছে এবং কার্যকর কূটনৈতিক পথ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতিনিয়তই নতুন যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বর্তমান উত্তেজনার সঙ্গে চলতি বছরের অক্টোবরে বিলুপ্ত হওয়া ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ)-র মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টিও যুক্ত করেছে সংবাদমাধ্যমটি। চুক্তির পতনের ফলে তেহরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয় এবং পারমাণবিক আলোচনা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
নিউইয়র্ক টাইমস আরও জানায়, উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সব মজুত ধ্বংস হয়ে গেছে তেহরানের এমন দাবির পরও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখনো বিশ্বাস করেন, এর কিছু অংশ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে তেহরান।
উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেও বাড়ছে উদ্বেগ। দেশগুলোর ধারণা, ইরানের ওপর আরেকটি ইসরায়েলি হামলা ‘হবে কি না’ এটা প্রশ্ন নয়, বরং ‘কখন হবে’ সেটাই মূল বিষয়। ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি একটি অস্তিত্বগত হুমকি। এর ফলে সামরিক হামলার বিকল্পটি আর কল্পনা নয়, বরং প্রায় অনিবার্য।
এদিকে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ জানান, তার ইরানি সূত্রগুলো বলছে, ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু রয়েছে এবং নতুন কোনো সংঘাত হলে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে একসঙ্গে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর আগে গেল জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে ৫০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল তেহরান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত থাকায় সংঘাতের একটি চক্রাকার ধারা তৈরি হয়েছে। গত জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে এবং বিশেষ করে গত বছর সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর বড় ধাক্কা খেয়েছে ইরানের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা ‘প্রতিরোধের অক্ষ’। তবুও এখনো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক রসদ রয়েছে তেহরানের হাতে। যেমন- ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ (হুতি), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া। এসব শক্তির মাধ্যমে এখনো এক ধরনের অপ্রতিসম প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রেখেছে তেহরান।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানায়, দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার এক শীর্ষ সূত্রের দাবি- ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারির আগে ইরানে শাসক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেছে ইসরায়েল। সূত্রটি জানায়, ইরান একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইরানের পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে রেখেছে তেল আবিব। ফলে আরেকটি সামরিক সংঘাত এখন কেবল সময়ের ব্যাপার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, নাতাঞ্জের দক্ষিণে ‘পিকাক্স মাউন্টেন’ নামে পরিচিত একটি নতুন ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম স্থাপনার নির্মাণ করছে ইরান। যেখানে জাতিসংঘের পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএর পরিদর্শকদের এখনও প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান শান্তি ও সংলাপ চায়, তবে চাপের কাছে মাথা নত করবে না, পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিও পরিত্যাগ করবে না। তার মতে, এসব কর্মসূচি জাতীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি বহুপক্ষীয় আলোচনায় ফেরার আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছেন যে ইরানের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।
জুনে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত ছিল বলে স্বীকার করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও বলেন, ওয়াশিংটন চাইলে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতেও প্রস্তুত। ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। সেখানে ট্রাম্প আবার বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি চায় এবং ওয়াশিংটন আলোচনায় প্রস্তুত।
একই দিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ির উপদেষ্টা কামাল খারাজি জানান, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইরান, তবে প্রথম পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকেই নিতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তবে, ব্যালিস্টিক-ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। এটিকে জাতীয় প্রতিরোধের একটি মূল স্তম্ভ বলে অভিহিত করেন।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিস্থিতিকে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখছে। ইসরায়েল চাচ্ছে, তারা এই সুযোগে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেবে। আর তাই তেহরান আশাবাদী কথাবার্তায় ভরসা করছে না। ইরানি কূটনীতিকদের ধারণা, ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করেই সামরিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, ইসরায়েল হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে যে কোনোভাবে সংঘাতে টেনে আনার চেষ্টা করবে।
ফলে ইসরায়েলের কৌশলগত দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, ওয়াশিংটন ইচ্ছা করুক বা না করুক এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার ইরান যদি ইসরায়েলি হামলার প্রতি আরও জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে একটি কঠিন বিকল্প থাকবে- হস্তক্ষেপ করা অথবা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারানো।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ইরানের রাষ্ট্র হিসেবে ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্তিত্বগত প্রশ্ন উত্থাপন করবে। তবুও, তেহরান জোর দিয়ে বলে যে তারা ধ্বংসের ভয় পায় না। একইসঙ্গে তারা সতর্ক করে জানিয়েছে, একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধ হলে ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেবে তারা।
সূত্র: আরটি

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.