সদাচারণের শক্তি এবং দুর্ব্যবহারের ক্ষতি

সদাচারণের শক্তি এবং দুর্ব্যবহারের ক্ষতি

সদাচারণের শক্তি এবং দুর্ব্যবহারের ক্ষতি

আজকের দ্রুত পরিবর্তিত সমাজে আমাদের আচরণ আমাদের জীবনের গুণগত মান এবং সম্পর্কগুলোর ভিত্তি। নবীজী (স.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে সদাচারীরা এবং সবচেয়ে অপ্রিয় হচ্ছে বদমেজাজীরা।” আমরা সবাই নিজেকে উন্নত করতে চাই, আমাদের আত্মার প্রকৃত সম্ভাবনা উন্মোচিত করতে চাই। কিন্তু এর অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা হলো দুর্ব্যবহার। আজকের আলোচনা থেকে আমরা জানবো কিভাবে দুর্ব্যবহার আমাদের আত্মজাগরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কীভাবে তা আমাদের সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, এবং আমরা কীভাবে সঠিক পথে জীবন পরিচালনা করতে পারি।

দুর্ব্যবহার ও আমাদের সামাজিক জীবন

আমরা যখন অন্যের সাথে আমাদের আনন্দ ও দুঃখ ভাগ করি, তখন আমাদের সুখ বৃদ্ধি পায় এবং দুঃখ কমে। কিন্তু দুর্ব্যবহারের পরিণতি হলো একাকীত্ব। বদমেজাজী মানুষ সবসময় একা থাকে, এমনকি তার পরিবারেও। খিটখিটে এবং রাগী মেজাজের কারণে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাগের ফলে হার্ট রেট বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুততর হয় এবং দীর্ঘমেয়াদে তা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মাইগ্রেন এবং আরও অনেক অসুখের কারণ হতে পারে। রাগের প্রভাবে এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে, যা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে।

রাগ ও শারীরিক স্বাস্থ্য

রাগের ফলে আমাদের শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে পরিবর্তন আসে। আমাদের হৃদস্পন্দন বাড়ে, শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ত্বরান্বিত হয়। এসব শারীরিক পরিবর্তন যখন বারবার ঘটে, তখন আমাদের স্বাস্থ্য গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, মানুষ হৃদরোগ বা স্ট্রোকের শিকার হতে পারে। এজন্য, রাগ এবং খিটখিটে মেজাজের প্রভাব আমাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শক্তির আসল পরিচয়

সত্যিকারের শক্তি কিন্তু রাগ ও উত্তেজনায় নয়, বরং শান্তি, ধৈর্য, এবং প্রজ্ঞায় থাকে। জার্মান দার্শনিক নীটশে বলেছিলেন, “সত্যিকারের যোদ্ধা সে, যে জানে কখন অস্ত্র সংবরণ করতে হয়।” আমাদের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, সেটা বজায় রাখা, এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা—এটাই আমাদের প্রকৃত শক্তি। যখন আমরা আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করি, তখন আমাদের জীবনও সঠিক পথে পরিচালিত হয়।

দুর্ব্যবহার কাদের সাথে করি? আমরা সাধারণত আমাদের পরিবারের কাছের মানুষদের সাথে বেশি দুর্ব্যবহার করি, যাদের সাথে আমাদের আবেগীয় সম্পর্ক রয়েছে—যেমন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান। অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীর সাথে সুষ্ঠুভাবে কথা বলেন না, তেমনি অনেক স্ত্রীরাও স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার করেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যাদের সাথে আমরা কোনো ক্ষমতা বা অধিকার সম্পর্কিত অনুভূতি রাখি, যেমন গৃহকর্মী, অফিসের পিয়ন, দারোয়ান, ড্রাইভার—তাদের সাথে দুর্ব্যবহার না করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করা।

দুর্ব্যবহার ও প্রতিকার: অনেক সময় আমরা নিজেদের দুর্ব্যবহারের জন্য যুক্তি দিই। আমরা বলি, “অন্যায় করলে তো প্রতিবাদ করতেই হবে!” কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিবাদ করে কখনো সমস্যা সমাধান হয় না; বরং তা আরও জটিল হয়ে যায়। সঠিকভাবে সমস্যা মোকাবেলা করতে হলে আমাদের বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা ব্যবহার করতে হবে। একাধিক কাহিনীতে দেখা গেছে, মানুষ যখন সঠিক সময়ে সঠিক আচরণ করেছে, তখনই প্রকৃত শিক্ষা পেয়েছে এবং শান্তি পেয়েছে।

ক্ষমা এবং রাগ নিয়ন্ত্রণ

ক্ষমা করার ক্ষমতা হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, “রাগ সাময়িক অনুভূতি। যদি আপনি ইতিবাচক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন, তবে তা সহজেই ভুলে যাবেন।” নিয়মিত মেডিটেশন এবং আত্মপ্রতিবেদন আমাদের ধৈর্য বৃদ্ধি করে, যা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। আমাদের নিজের আচরণের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং আমরা অন্যদের অবস্থান বুঝতে শিখি।

যত বড় উপহার দেওয়া যায় না, তত বড় মনোভাব এবং আচরণই মানুষের মনে বেশি ছাপ ফেলে। যদি আমরা সদাচারণ, বিনয়, এবং ধৈর্য প্রদর্শন করি, আমাদের জীবন আরও শান্তিপূর্ণ এবং সুখী হবে। আমরা যদি আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করি, তাহলে আমাদের সম্পর্ক এবং জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। চলুন, আমরা সবাই মিলে সদাচরণের এবং সহানুভূতির পরিবেশ গড়ে তুলি, যাতে প্রতিটি মানুষ সম্মানিত, মূল্যায়িত এবং ভালোবাসার অনুভূতি পায়।

 

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.