‘শীতকাল গেল না’
জানালার কার্নিশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিম গাছটা কচি সবুজ পাতায় ছেয়ে যায় এই সময়টায়। তার ওপরে সবুজাভ ফুল বনজ সুবাস ছড়ায়। বাতাসে থাকে বসন্তের ওম চৈত্রের প্রচণ্ডতা। এবারও বসন্ত, অথচ কার্নিশ ছুঁয়ে থাকা অতি আপন প্রতিবেশীর মতো নিম গাছটা অস্থিচর্মহীন কঙ্কালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। তবে কি শীতকাল গেল না!
তোমার অস্থির ভেতরে এক একঘেয়ে বিষন্ন শীতভাব প্রতিদিন জানান দেয় তার অস্তিত্বের। বিপন্ন করে তুলতে চায় সবকিছু।
আগুণ আগুণ দেখো সবখানে। তোমার ডাইনিং টেবিলটা লাস্ট সাপার নামক চিত্রকর্ম হয়ে শোভা পাচ্ছে পত্রিকার পাতায় পাতায়। এখনো ভস্ম হয়ে যায় নাই তাই। অথচ তুমি ও তোমরা কেউ নাই, কোথাও নাই।
নবী সুলেমানের নির্দেশে জ্বলন্ত আগুন শীতল হয়ে উঠেছিল কথাটা কি সত্যি? আজ খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে কথাটা। পাল্টে দিতে ইচ্ছা করছে সবকিছুর সংজ্ঞা। একটা পরিবর্তন, হ্যাঁ, একটা পরিবর্তনের অপেক্ষায় থেকে থেকে কেটে যায় তোমার বছরের পর বছর। কোথায় না চেয়েছিলে তুমি সেই পরিবর্তন- ব্যক্তিজীবনে, সমাজে বা রাষ্ট্রে! অথচ পরিবর্তন যেন সোনার হরিণ।
তুমি চাও নাই, সত্যি তুমি চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি পশুর মতো জীবন চাও নাই। একটা কেমিক্যাল গুদামের ওপর মুহূর্তের অসতর্কতায় ভস্ম হয়ে যাওয়া জীবন তোমার চাওয়া ছিল না। মানুষের লোভ তার সব রকম কদর্যতা নিয়ে গ্রাস করেছে তোমাদের।
আর তারপর, শতশত প্রাণ-স্বপ্ন-আকাঙ্খা সব বিলীন হয়ে যাওয়ার পর। বেঁচে থাকা মানব ফসিলগুলো যখন তাদের টিকে থাকার নিদেন পক্ষে মৃত্যুর স্বাভাবিক গ্যারান্টি চেয়ে বসল, তখনো সেই অদ্বুত লোভাতুর মুখগুলো ভেঙচি কাটতে লাগল। প্রকাশ্য হয়ে উঠতে লাগল নীতি নির্ধারকদের সাথে তাদের দেন দরবার। তাদের হিং¯্র নখর বসে যেতে লাগল তোমাদের নাজুক কাঁধে।
কতগুলো মামুলি শর্ত আর মিথ্যা আশ্বাসের ভিত্তিতে তারা পেয়ে গেল তোমাদের মতো আরো শত শত মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার লাইসেন্স!
একথা জেনে তুমি একটুও অবাক হও নাই। বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা তো তোমার কবেই লোপ পেয়েছে। যেদিন একটা কৃত্রিম লাইনের শেষ মাথায় তিন ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও তুমি তোমার মত প্রকাশের একমাত্র অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলে, সেদিন থেকেই তো জানতে এ শীত এ কুয়াশা কাটার নয়।
লেখক: গাজী তানজিয়া, কথাসাহিত্যিক