শিশুর মননে ঈমানের বীজ: গড়ে তুলুন আলোকিত ভবিষ্যৎ

শিশুরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তাদের অন্তরে সঠিক বিশ্বাস, নৈতিকতা ও আল্লাহভীতি প্রতিষ্ঠা হলে সমাজ পায় সৎ, দায়িত্বশীল ও শান্তিপ্রেমী নাগরিক। ইসলাম শৈশব থেকেই ধর্মীয় শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে, কারণ এই শিক্ষাই শিশুদের হৃদয়ে ঈমান ও চরিত্রের ভিত্তি স্থাপন করে। নবী করিম (স.) বলেছেন, ‘সন্তানকে দেওয়া পিতার সর্বোত্তম উপহার হলো শিষ্টাচার।’ (তিরমিজি: ১৯৫২)

ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব: কোরআন-হাদিসের আলোকে

একটি শিশুর জীবনে প্রথম প্রয়োজন তার সৃষ্টিকর্তার পরিচয় জানা। তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতের ধারণা শিশুর ঈমানকে সুদৃঢ় করে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা।’ (সুরা আনফাল: ২৮) অর্থাৎ সন্তান শুধু আনন্দের উৎস নয়, তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা এক বড় দায়িত্ব। শৈশব থেকেই তাদেরকে হালাল-হারামের জ্ঞান দেওয়া জরুরি।

নৈতিক চরিত্র গঠনে ধর্মীয় শিক্ষা সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম। সততা, দয়া, নম্রতা, লজ্জাশীলতা, দায়িত্ববোধ—এসব গুণ শিশুর মাঝে আল্লাহর ভয় ও পরকালের জবাবদিহির বোধ তৈরি করে। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘‘তোমরা সন্তানদের নামাজের প্রতি যত্নবান হও এবং তাদের ভালো কাজে অভ্যস্ত করো। কেননা কল্যাণ লাভ অভ্যাসের ব্যাপার।’ (সুনানে বায়হাকি: ৫০৯৪)

মা-বাবার ওপর সন্তানের ঈমান রক্ষা করা আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব। রাসুল (স.) বলেন, ‘জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি: ৭১৩৮) তাই সন্তানের ধর্মীয় শিক্ষা অবহেলা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামে শৈশব থেকেই হৃদয়কে ঈমানের আলোয় আলোকিত করার নির্দেশ এসেছে। নবজাতকের কানে আজান দেওয়া (শুআবুল ইমান: ৮৬১৯) এবং প্রথমে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শেখানোর সুন্নতও শিশুর মনে তাওহিদের বীজ রোপণের অংশ।

 


কোরআন শিক্ষা শিশুদের মৌলিক অধিকার। হজরত উমর (রা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কিতাব শেখানো মা-বাবার ওপর সন্তানের অধিকার।’ (তারবিয়াতুল আওলাদ)। কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া-মাসায়েল ও শরিয়তের মৌলিক বিধান শেখানোর মাধ্যমে তাদের বিশ্বাসের ভিত শক্ত হয়।

সমাজিক প্রেক্ষাপট ও আধুনিক চ্যালেঞ্জ

ধর্মীয় শিক্ষা সমাজে ন্যায়, সত্য, ধৈর্য, পরহেজগারি ও সম্মানবোধ প্রতিষ্ঠা করে। কোরআনে একাধিক স্থানে আল্লাহ মানুষকে সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ ও সৎ হতে বলেছেন। এই নৈতিক মূল্যবোধগুলো শিশুদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই শেখাতে পারলে পরিবারে শান্তি, সমাজে শৃঙ্খলা ও মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়।

আজকের শিশু প্রযুক্তি, গেমস, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভ্রান্তিকর ধারণায় সহজেই আক্রান্ত হতে পারে। কোরআন সতর্ক করে বলে, ‘নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; অতএব তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য কর।’ (সুরা ফাতির: ৬) তাই ধর্মীয় শিক্ষা শিশুকে বিভ্রান্তি ও নৈতিক স্খলন থেকে রক্ষা করে, সঠিক-ভুলের পার্থক্য শেখায় এবং চরিত্রকে পবিত্র রাখে।

অভিভাবকের দোয়া

সন্তানের সুশিক্ষা আল্লাহর কাছেও চাইতে হবে। কোরআনে এসেছে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া: رَبِّ اجۡعَلۡنِیۡ مُقِیۡمَ الصَّلٰوۃِ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِیۡ رَبَّنَا وَ تَقَبَّلۡ دُعَآءِ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানিয়ে দিন এবং আপনি আমার দোয়া কবুল করুন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪০)

 

মুমিন সুসন্তান লাভের জন্য এই দোয়াও করবেন: رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ اَزۡوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعۡیُنٍ وَّ اجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِیۡنَ اِمَامًا ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন যারা হবে আমাদের জন্য চোখজুড়ানো। আর আপনি আমাদেরকে করুন মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য।’ (সুরা ফুরকান: ৭৪)

মায়ের ভূমিকা: ইসলামে মায়ের স্থান অত্যন্ত উচ্চ। মা হচ্ছেন সন্তানের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। গর্ভকাল থেকে সন্তানের ওপর মায়ের প্রভাব অপরিসীম। তাই সন্তানের সুশিক্ষার ভিত্তি রচনায় মায়ের দায়িত্ব ও ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ।

রোল মডেল হিসেবে অভিভাবক: শিশুরা কথা শুনে শেখার চেয়ে দেখে শেখে বেশি। তাই শিশুর সামনে অভিভাবকের নিজের আমল-আখলাক, নামাজ-রোজার প্রতি যত্নবান হওয়া, সততা ও দয়াদ্রতার চর্চা—এসবের গুরুত্ব অপরিসীম। অভিভাবকের জীবনের আদর্শই হয়ে উঠতে পারে শিশুর জন্য সবচেয়ে বাস্তব ও কার্যকর শিক্ষা।

পরিবারে ইসলামি আবহ তৈরি করাও জরুরি। কোরআন তেলাওয়াত, আজান ও দোয়ার পরিবেশ শিশুর হৃদয়কে কোমল করে। খাবারের আগে ‘বিসমিল্লাহ’ শেখানো, রাতে ঘুমানোর দোয়া, ছোট নৈতিক গল্প—এসবই চরিত্র গঠনের অংশ হয়ে যায়।

 

সুরা লুকমানের উপদেশ শিশু শিক্ষার এক অনন্য নকশা। লুকমান (আ.) তার সন্তানকে প্রথমে তাওহিদ শিক্ষা দিয়ে বলেন, ‘হে পুত্র! আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো না।’ (সুরা লুকমান: ১৩) তিনি আরও বলেন, ‘সৎকাজের নির্দেশ দাও, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো, বিপদে ধৈর্য ধরো।’ (সুরা লুকমান: ১৭) আর অহংকার ও উদ্ধত আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না।’ (সুরা লুকমান: ১৮)

শিশুকে কোরআন-হাদিসভিত্তিক পরিবেশে শিক্ষিত করতে মক্তব-মাদ্রাসা-মসজিদের সঙ্গে যুক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তারা শিষ্টাচার, আল্লাহভীতি ও দীনদারির প্রথম পাঠ পায়।

ধর্মীয় শিক্ষা শুধু ইবাদতের পাঠ নয়; বরং এটি শিশুর ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, মূল্যবোধ, আচরণ ও নেতৃত্বের ভিত্তি। কোরআন-হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সন্তানকে সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া প্রতিটি অভিভাবকের ফরজ দায়িত্ব। ধর্মীয় শিক্ষায় গড়ে ওঠা শিশুই ভবিষ্যতে হবে নীতিমান নাগরিক, ন্যায়পরায়ণ নেতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাজের স্থপতি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সন্তানদের নেক, সৎ, ঈমানদার, আমলদার ও দ্বীনদার করে তোলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

You might also like

Comments are closed.