‘ছোট ছোট শিশুদের/শৈশব চুরি করে/গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ’– নচিকেতার এ গানের মতো গ্রন্থকীটের দল নির্বোধ বানায় কিনা জানি না। তবে আমরা অভিভাবক এবং এখনকার শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশে শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। অভিভাবকরা যারা আশির দশকের মাঝামাঝি কিংবা নব্বই দশকে যারা বড় হয়ে উঠেছি; আমাদের শৈশবটা এমন ইট, কাঠ, কংক্রিটের পাথরে বন্দি ছিল না। তা ছিল উদ্দাম, উচ্ছল শৈশব। অন্তত বিদ্যালয়ের অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে লেখাপড়ার জুজুবুড়িটা আমাদের দুরন্ত শৈশব এভাবে গ্রাস করতে পারেনি। সারাক্ষণ কেবল গাদাগাদা বই আর কঠিন কঠিন হোমওয়ার্কে আমাদের মুখ বুজে থাকতে হতো না। এখনকার শিক্ষাব্যবস্থায় ঢাকা শহরের নামিদামি ইংরেজি আর বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রম দেখলে একজন অভিভাবক এবং শিক্ষিকা হিসেবে আমার মনে হয়, এই পাঠ্যক্রম তাদের স্বাভাবিক বিকাশে সহায়ক তো নয়ই, বরং জোর করে অনেক কিছু তাদের গেলানো হয়। দুর্বোধ্য সব ইংরেজি সহপাঠ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বই, প্রজেক্ট ওয়ার্ক শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশে সহায়ক নয়। বরং লেখাপড়া নিয়ে অহেতুক ভীতির উদ্রেক করছে তাদের মনে।
একটা ফল যখন জোর করে মেডিসিন দিয়ে পাকানো হয়, তা খেতে আপাত মিষ্টি হলেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এখনকার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে তেমন আনন্দের যোগ নাই, তা শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত করছে। আমাদের দেশেও ইদানীং অনেক স্কুলে শিক্ষার্থী অতিরিক্ত লেখাপড়া আর বাবা-মার প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল করতে না পেরে আত্মহত্যা করছে। আমরা যদি সচেতন না হই, অদূর ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। দুরন্ত, কোমলমতি শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দিতে হবে। অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে ওদের জীবনের এই সুন্দর সময়টা কোণঠাসা করে ফেলা উচিত নয়। তমুকের সন্তান পারছে, আমার সন্তান কেন পারছে না– বাচ্চাদের নিয়ে এ ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া মোটেও উচিত নয়। একজন সন্তানের সঙ্গে অভিভাবক কিংবা শিক্ষকদের মতো নয়, বন্ধুর মতো মেশা দরকার। বুঝতে হবে, ওদের মনের চাওয়া-পাওয়া কী? শুধু অনেক পয়সা দিয়ে হোম টিউটর রেখে দিলেই অভিভাবক হিসেবে আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে গেল না।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে আমরা সন্তানের হাতে দামি স্মার্টফোন তুলে দিয়ে ওদের সাময়িক খুশি করছি ঠিকই। কিন্তু এখনকার বাচ্চারা জানে না কোন পাখির কী রং। কোন গাছের পাতা কেমন; বৃষ্টিতে ভিজলে মাটির কেমন গন্ধ তৈরি হয়। বছরে অন্তত একবার হলেও ওদের প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া জরুরি। ওরা মাটির গন্ধ, প্রকৃতির টান একটু হলেও অনুভব করতে শিখুক। তখন হয়তো অভিভাবক হিসেবে আমাদেরও মনে হবে, শৈশবের অকৃত্রিম রং কিছুটা হলেও আমরা ওদের ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।
রসহীন শৈশব শিশুকে পরিপূর্ণতা দেয় না। শীতের কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জেগে সবুজ ঘাষের ওপর কুয়াশা দেখতে দেখতেই একদিন শিশুরা নিজের থেকেই চিন্তা করতে শিখবে। গ্রীষ্ম কিংবা শরতের বিকেলে নদীর তীরে হাঁটতে গিয়ে বাতাসে দোল খেতে খেতেই তারা হয়ে উঠবে পরিপূর্ণ মানুষ।
লেখক: সংগীত শিক্ষক, মোহাম্মদপুর, ঢাকা