রেস্তোরাঁ ব্যবসায় সুবাতাস, ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন
বিগত এক দশকে দেশের রেস্তোরাঁ শিল্পে এসেছে বড় পরিবর্তন। জিডিপির পাশাপাশি প্রতিবছর বাড়ছে কর্মসংস্থান। ঢাকা ছাড়াও সারাদেশের ছোট-বড় শহরে গড়ে উঠেছে উন্নতমানের রেস্তোরাঁ। উন্নত বিশ্বের আদলে অনেক চেইন রেস্তোরাঁও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও রুচির পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের। এর মধ্যেই সম্প্রতি সরকারিভাবে রেস্তোরাঁকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সরকারের এ ঘোষণায় উচ্ছ্বসিত ব্যবসায়ীরা। উন্নত বিশ্বের মতো দেশের রেস্তোরাঁ ব্যবসাকেও একটি মানসম্পন্ন জায়গায় নিতে স্বপ্ন বুনছেন তারা।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেস্তোরাঁর প্রসারে এ শিল্পে এখন পর্যন্ত বিপুল কর্মসংস্থানও হয়েছে। দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি এ শিল্প কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পর্যটনসহ অন্যান্য অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখছে। সরকার শিল্প ঘোষণা করায় আগামী এক দশকে এ শিল্প আরও তিনগুণ প্রসার হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হোটেল ও রেস্টুরেন্ট সার্ভে-২০২১ এর তথ্য বলছে, গত ১১ বছরে দেশে হোটেল ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার। ২০০৯-১০ সালে যেখানে দেশে রেস্তোরাঁর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার, তা গত বছর বেড়ে ৪ লাখ ৩৬ হাজার হয়েছে।
এ সময়ে সেখানে কর্মরত মানুষের সংখ্যাও হয়েছে দ্বিগুণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর্মরত ছিলেন ৯ লাখ ৪ হাজার মানুষ, যা গত বছর বেড়ে ২০ লাখ ৭২ হাজার হয়েছে। ফলে এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে মূল্য সংযোজন বেড়েছে আট গুণ। এক দশক আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে মূল্য সংযোজন হয়েছিল মাত্র ১১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। আর সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয়েছে ৮৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।
এ পরিস্থিতিতে আগামী ১০ বছরে এ শিল্প আরও তিনগুণ এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান। তিনি বলেন, সরকারের উদ্যোগে রেস্তোরাঁকে শিল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এতে আমাদের খাতের বিদ্যমান অনেক সমস্যা সমাধান হবে। বর্তমানে এ শিল্প যে অবস্থায় রয়েছে, আগামী ১০ বছরে তা আরও তিনগুণ বাড়বে।
‘পৃথিবীজুড়ে এখন এ শিল্প সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশেও সেটা হবে। আগামীতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো মানুষ রেস্তোরাঁনির্ভর জীবনযাপন করবে। সেভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও অভ্যাস গড়ে উঠছে।’
ইমরান হাসান বলেন, এছাড়া আগামীতে এ শিল্প থেকে প্রচুর প্রশিক্ষিত কর্মী রপ্তানি সম্ভব হবে। সেটি অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। আবার বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত প্রবাসীরাও এ খাতে জড়িয়ে পড়ছে ব্যাক টু ব্যাক শিল্পের মতো। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বিশ্বব্যাপী হসপিটালিটি খাতে দুই কোটি কর্মী রপ্তানি সম্ভব।
এসব বিষয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন রেস্তোরাঁ মালিকের সঙ্গে। তারা জানান, অপেক্ষাকৃত কম পুঁজিতে বাংলাদেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা লাভজনক। এছাড়া মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এ শিল্প জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ। সে কারণেই ঢাকা নয়, জেলা ও উপজেলায়ও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন হোটেল-রেস্তোরাঁ গড়ে উঠছে। আবার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন খাদ্যের প্রসার এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে। যে কারণে দেশের অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে এ শিল্পের।
তারা আরও বলেন, এতদিন রেস্তোরাঁ ব্যবসা শিল্পের মর্যাদা না পাওয়ার কারণে বেশ সমস্যা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের সরকারি সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে চড়া মূল্য দিতে হতো। ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে অনেকে। তাছাড়া ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে যে সব প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের ব্যবসার প্রসার করেছেন, তারা প্রতিনিয়ত চড়া সুদ গুনেছে।
ঋণ পরিশোধ সব সময়ই আর্থিক চাপ, এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠান টিকতে পারেনি। শিল্প না হওয়ার কারণে এতদিন রেস্তোরাঁ ব্যবসা দেশের পুঁজিবাজার, বিশেষ করে সম্ভাবনাময় বন্ড মার্কেট গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও কোনো ভূমিকা নেয়নি।
আল-কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টের কর্ণধার ফিরোজ আলম সুমন বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসা নির্ঞ্ঝাট নয়। বড় বড় রেস্তোরাঁয় এখন বিনিয়োগও প্রচুর। তারপরেও এ ব্যবসার কোনো স্বীকৃতি ছিল না। কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহায়তা মেলেনি। সেজন্য এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের প্রায়ই নানা ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে অনেক তরুণের উদ্যোগ।
তিনি বলেন, এ খাত শিল্প হওয়ায় এখন অনেক সমস্যা কেটে যাবে। বড় বিনিয়োগ আসবে। কয়েক বছরের মধ্যে এ খাত পাল্টে যাবে। যেসব তরুণ উদ্যোক্তা রেস্তোরাঁগুলোতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে যাচ্ছেন তারা আরও উদ্যমী হবেন। ব্যাংকগুলো সব ব্যবসায় ঋণ দিলেও রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ঋণ দিতে চাইতো না। সহজ শর্তে ঋণ পেলে তরুণরা আরও ভালো করবেন।
রেস্তোঁরা ব্যবসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ওসমান গণির সঙ্গে। তিনি বলেন, এত বড় হওয়া সত্ত্বেও এতদিন রেস্তোরাঁ ব্যবসায় কোনো স্বীকৃতি ছিল না। সেটা না থাকায় সরকারের সুবিধাগুলো আমরা পাইনি, রেস্তোরাঁ ব্যবসা সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। এখন সে বাধা কেটেছে। রেস্তোরাঁকে অন্যান্য শিল্পের মতো সুবিধা দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ থেকে বিভিন্ন সেবায় আমরা সুবিধা পাবো। শিল্প সহায়তা পাবো। শিল্প না হওয়ার কারণে ব্যাংক লোন না পাওয়ার সমস্যারও সমাধান হবে।
তিনি বলেন, আমরা চাই, সরকার যে আন্তরিকতা নিয়ে এ খাতটি শিল্প ঘোষণা করেছে, সেরকমভাবে প্রজ্ঞাপন ভিত্তি করে এ বিষয়ে একটি ব্যবসাবান্ধব বিধি বা প্রবিধি প্রণয়ন করবে। যাতে এ শিল্পের অবদান দ্রুততম সময়ে অর্থনীতিতে অন্যতম সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নীতি, আইন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা) শেখ ফয়েজুল আমীন বলেন, মোটাদাগে এখন অন্যান্য শিল্পের মতো সব সুবিধাপ্রাপ্ত হবে রেস্তোরাঁগুলো। তাতে এ ব্যবসায় সরকারের সহায়তা বাড়বে। বড় বড় বিনিয়োগ আসবে। ব্যাংকগুলোও বিনিয়োগকারীদের সহায়তা দেবে। এমনকি এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে।