‘রায়ের কপি পেতে যেন বিচারপ্রার্থীদের আদালতের বারান্দায় ঘুরতে না হয়’
মামলার পরিমাণ দিন দিন যে হারে বাড়ছে, সেটাকে আয়ত্তের মধ্যে আনতে হলে বিচারকদের আরো বেশি কাজ করতে হবে। বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে, মামলার রায় পাওয়ার পর রায়ের কপি পেতে যেন দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করতে না হয়। শুক্রবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় এক ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ।
রাষ্ট্রপতি আব্দুুল হামিদ বলেন, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। তাই মনে রাখতে হবে একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পাওয়া তার অধিকার। আর নাগরিকের সে অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখানে দয়া বা আনুকূল্যের কোনো বিষয় নেই।
দেশ, জনগণ ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সবাই তাদের মেধা ও মনন প্রয়োগের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন। সুপ্রিম কোর্ট দিবসে এটাই সবার প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেন, আমি নিজে একজন আইনজীবী হিসেবে জানি বিচারকাজ কতো কঠিন ও জটিল। বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় একজন বিচারককে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু তারপরেও আমি বলবো মামলা দিন দিন যে হারে বাড়ছে সেটাকে আয়ত্তের মধ্যে আনতে হলে বিচারকদের আরো বেশি কাজ করতে হবে। আর সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং বিচারকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে মামলার রায় হওয়ার পর রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের যেন আদালতের বারান্দায় দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি করতে না হয়।
রাষ্ট্রপতি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম হলো শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ তৈরি করা। উন্নয়নের সঙ্গে ন্যায়বিচার এবং আইন-আদালতের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, বিরোধের মীমাংসা যথাযথভাবে না হলে আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। আর এই প্রক্রিয়া বারবার চলতে থাকলে রাষ্ট্র ও সমাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করে জনগণের ক্ষোভ প্রশমন করে। এতে সমাজে বৈষম্য দূরীভূত হয় এবং রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আর এভাবেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। নাগরিকদের আয় ও সুবিধার ভিন্নতা বা আর্থিকভাবে অসচ্ছলতার কারণে কেউ যাতে ন্যায় বিচার বা আইনের সমান আশ্রয়লাভ থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে গঠিত হয়েছে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা। আশা করি, এর মাধ্যমে দেশের আদালতে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও দুর্গত বিচারপ্রার্থীরা মামলার শুরু থেকে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত সব আইনগত সহায়তা পাবে।
প্রযুক্তি ব্যবহার প্রসঙ্গে আব্দুল হামিদ বলেন, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে অনলাইন কজলিস্ট চালু হয়েছে এবং অনলাইন বেল কনফার্মেশন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে চলছে। আমি একইভাবে আদালতের সমস্ত কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু ‘কোর্ট অব রেকর্ড’ সেহেতু এর সব নথি এবং মামলা দায়ের থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রমকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।
বিচারকদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতির ক্রান্তিকালে যখনই প্রয়োজন হয়েছে, তখনই সুপ্রিম কোর্ট মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও সংবিধানকে রক্ষা করেছে এবং করে যাচ্ছে। তাই আজকের এই সুপ্রিম কোর্ট দিবসের অনুষ্ঠানে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি সুপ্রিম কোর্টের সেই সব অকুতোভয় বিচারপতিদের যাঁরা বন্দুকের নলের কাছে নতি স্বীকার না করে এবং নিজেদের বিবেককে বিকিয়ে না দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন।
বিচারকদের উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর ভূমিকা পালনে আমরা সদা সচেষ্ট থাকবো। আমি বিশ্বাস করি আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিচার বিভাগ মানুষের কল্যাণে আরো দ্রুততার সঙ্গে কাজ করলে বিচারপ্রার্থী জনগণের আস্থা আরো বেড়ে যাবে।
প্রধান বিচারপতি আরো বলেন, ইতিমধ্যে অধস্তন আদালত তাদের ১৫ দিন অবকাশ কালীন ছুটি বাতিল করেছেন। এতে বিচারপ্রার্থীদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে। আমরা দেশের দু’জন প্রথিতযশা আইনজীবীকে হারিয়েছি। একজন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আরেকজন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। আমরা তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, বিচারের সমতা নীতির মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করছি। কারণ, জনগণের আস্থাই বিচারকদের বড় সম্পদ। করোনার ক্রান্তিকালে ভার্চ্যুয়ালি বিচার বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে উল্লেখযোগ্য হারে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, করোনাকালীন সময়ে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট পরিচালনা করে বিচারকাজ চালু রেখেছেন যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এর মাধ্যমে গোটা বিচার বিভাগের দক্ষতা ও সক্ষমতারও পরিচয় ফুটে উঠেছে। বিচার বিভাগের আজকের অবস্থানের পিছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অনস্বীকার্য।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন ও সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।