রাজু ভাস্কর্য: কে সেই রাজু, শহীদ হয়েছিলেন কীভাবে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকার সড়কের ওপর সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই ভাস্কর্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গুলিতে শহীদ হওয়া মঈন হোসেন রাজুর স্মৃতিকে জীবন্ত রাখতে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল। যে রাজুর নামে এ ভাস্কর্য, আজ বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) তার মৃত্যুবার্ষিকী।

রাজু শহীদ হয়েছিলেন ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। কাকতালীয়ভাবে তখনো পবিত্র রমজান মাস চলছিল। রাজুর কিছু হয়েছে, এ খবর পরিবারের সদস্যরা ফোনে জানতে পারেন ইফতারের সময়।

তড়িঘড়ি করে সেই সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান রাজুর মা–বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। রাজুর মরদেহ দাফনের পর তারা তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পূর্বাপর জানতে পেরেছিলেন।

 মঈন হোসেন রাজু। ছবি: সংগৃহীত

১৯৮৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন রাজু। উঠেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে।

ক্যাম্পাসে আসার আগেই বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে তার সংযোগ আরও নিবিড় হয়েছিল।

রাজু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, তখন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনে রাজু সক্রিয় ছিলেন। তিনি যখন শহীদ হন, তখন ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমাজকল্যাণ সম্পাদক।

রাজু শহীদ হওয়ার পর তার স্মরণে ১৯৯৭ সালে টিএসসি এলাকার সড়কে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী এ ভাস্কর্যের নকশা করেছিলেন।

এরপর প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আন্দোলন-কর্মসূচির স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে এ ভাস্কর্য।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার যে গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, সেই আন্দোলনের প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কর্মসূচি পালিত হয়েছিল রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন আন্দোলন-প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও রয়েছে রাজু ভাস্কর্য।

শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহকে গত ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ কর্মসূচির জন্য শিক্ষার্থীদের রাজু ভাস্কর্যে আসার জন্য আহ্বান জানাতে দেখা গেছে। তিনি ফেসবুকে কয়েকবার ‘সবাই রাজুতে আয়’ লিখে পোস্ট দিয়েছিলেন।

রাজু ভাস্কর্যে কালো কাপড় বেঁধে দিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ। ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে শহীদ হন রাজু: ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ মাহমুদ খান বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। তিনি শহীদ রাজুর বিভাগ ও হলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শহীদুল্লাহ হলে তারা দুজন থাকতেন একই কক্ষে। প্রিয় বন্ধুকে হারানোর দুঃখ এখনো তাকে তাড়া করে।

২০১৯ সালের মার্চে আবদুল্লাহ মাহমুদ খান রাজু হত্যার ঘটনার একটি বিবরণ দিয়েছিলেন। তার ভাষ্য, পরদিন সকাল নয়টায় আসার কথা বলে ১২ মার্চ সন্ধ্যায় রাজু বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু পরদিন ক্যাম্পাসে আসতে রাজুর দেরি হচ্ছিল। কিছুটা সময় অপেক্ষা করে মাহমুদরা চলে যান ক্রিকেট খেলতে। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে রাজু ক্যাম্পাসে আসেন। মারামারি হচ্ছে, এমন খবর শুনে রাজু ছুটে যান মধুর ক্যানটিনে।

সেখানে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মীরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের এক কর্মীকে মারধর করছিলেন। রাজুও জড়িয়ে পড়েন সেই মারামারির ঘটনায়। একপর্যায়ে তার হাত কেটে যায়।

মাহমুদ বলেন, ‘আমরা বেলা আড়াইটার দিকে শহীদুল্লাহ হলে এসে দেখি, রাজুর হাতে ব্যান্ডেজ। সকালের মারামারির কথা রাজুর মুখেই শুনি।’

রাজু বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। বন্ধুরা তাকে অসুস্থ অবস্থায় না ফিরে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে যেতে বললেন। পরে রাজু কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মাহমুদসহ তিন বন্ধুকে নিয়ে বাইরে বের হন। তাদের অন্য দুজন হলেন সাইফুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান।

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। এর মধ্যেই রিকশায় করে তারা টিএসসিতে যান। মাহমুদকে নিয়ে টিএসসির ভেতরে ঘুরে এসে বাইরের মূল ফটকে দাঁড়ান রাজু।

মাহমুদ বলেন, সেখান থেকে তারা দেখলেন, ডাস ক্যাফেটেরিয়ায় ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা বচসা শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্রদল হাকিম চত্বরের দিকে আর ছাত্রলীগ শামসুন নাহার হলের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সরে যেতে থাকল। এ ঘটনা যখন চলছিল, তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি–সংলগ্ন ফটকে অবস্থান করছিল পুলিশ। একপর্যায়ে টিএসসিতে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। মুহূর্তেই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় টিএসসি।

রাজুর বন্ধু মাহমুদের ভাষ্যে, ‘ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোড়ো হাওয়া আসে। শুরু হয় বৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি থেমে গেল। রাজু বন্ধুদের সঙ্গে টিএসসির মূল ফটকের সামনে দাঁড়াল। বৃষ্টি থামার পর পুলিশ ডাসের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। কিন্তু সন্ত্রাসী দুই দলের সদস্যরা তখনো অবস্থান করছিল শামসুন নাহার হলের সড়কদ্বীপ আর হাকিম চত্বরের দিকেই। পুলিশ অস্ত্রধারীদের কিছু না বলে উল্টো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সরে যেতে বলে।’

তখন রাজু ও তার বন্ধুরা পূর্ব দিকে টিএসসির দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়ান। পুলিশের রমনা থানার তৎকালীন ওসি তাদেরও বলেন, ‘তোমরা সরে যাও, আমরা দেখছি।’

প্রতিবাদী রাজু ওসিকে জবাব দেন, ‘আপনারা কী দেখছেন, তা তো আমরা সবাই দেখলাম। আপনার দুই পাশে থাকা সন্ত্রাসীদের কি চোখে পড়ছে না?’

ওসি রাজুর দিকে আঙুল তুলে অন্য পুলিশদের বলতে থাকেন, ‘এই ছেলেকে ধরো।’ রাজু উত্তেজিত হয়ে নিজের বুকের শার্টে হাত ধরে বলেন—‘ধর আমাকে’।

পরিস্থিতি সামলে নিতে চাইলেন মাহমুদ। তিনি রাজুকে টিএসসির মাঝখানে টেনে নিয়ে যান। রাজু তখন সহপাঠী রহিমের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘স্লোগান ধর রহিম।’

রহিম জানতে চাইলেন, কোন সংগঠনের ব্যানারে মিছিল হবে। রাজু ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য’–এর নামে স্লোগান দিতে বললেন।

এরপর মিছিল শুরু হলো। মাহমুদের ভাষ্য, ‘সামনের সারিতে ছিলাম আমরা পাঁচজন। আমার ডানে রাজু। ঠিক ভাস্কর্যের মতোই হাতে হাত ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম।’

১০-১২ জনের মিছিলটি টিএসসির পূর্ব দিকের ফটক থেকে ডাস ক্যাফেটেরিয়া ঘুরে হাকিম চত্বরের পাশ দিয়ে বর্তমান রাজু ভাস্কর্য এলাকা ঘুরে টিএসসিতে অবস্থান নেয়।

ততক্ষণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মিছিলটি বিশাল আকার ধারণ করে। আবার ঘুরে টিএসসির পশ্চিম দিকের সিঁড়িঘরের সামনে থামে শিক্ষার্থীদের মিছিলটি। এরপর সমাপনী বক্তব্য শুরু হয়।

ঠিক সেই মুহূর্তে ক্যাম্পাসে আবার গোলাগুলি শুরু হয়। রাজু ও সেই মিছিলের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একই পথে মিছিল বের করা হয়। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য অতিক্রম করে কিছু দূর যাওয়ার পর একটি গুলি ছোড়া হয়।

রাজু চিৎকার করে মাহমুদকে বলেন, ‘ওরা মিছিলের ওপর গুলি করেছে।’

পরমুহূর্তেই আরেকটি গুলি। রাজু মাহমুদকে টান দিলেন। মাহমুদ ভাবলেন, রাজু শুয়ে পড়ার জন্য তাঁকে টানছেন। মাহমুদ হাঁটু গেড়ে বসতেই তাঁর কাঁধে রাজু হেলে পড়লেন। তাঁর দুই চোখ তখন উল্টে গেছে।

সেই করুণ মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে মাহমুদ বলেন, ‘রাজুকে জড়িয়ে ধরে দেখলাম, ওর হাত বেয়ে রক্ত ঝরছে। মুহূর্তেই বুঝলাম, রাজু গুলিবিদ্ধ।’

পাশেই থাকা পুলিশের সাহায্য চাইলে তারা উল্টো দিকে দৌড় দেয়। কিছু দূর গিয়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের দিকেই কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। মিনিট পাঁচেক পর ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যেই মাহমুদ দেখতে পান, ডাসের দিক থেকে দুজন এগিয়ে আসছেন। তারা রাজুকে কোলে করে রিকশায় তুলে নেন। গুলিবিদ্ধ রাজুকে নিয়ে তারা ছোটেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাজু আর ফেরেননি। আর কোনো ঝাঁজালো মিছিলে দেখা যায়নি প্রতিবাদী রাজুকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ১৫ জুলাই ২০২৪। ছবি: সংগৃহীত

ইফতারের সময় খবর পায় পরিবার: রাজুর কিছু হয়েছে, এ খবর তার পরিবার পেয়েছিল ইফতারের সময়। ২০১৯ সালের মার্চে প্রথম আলোতে এক স্মৃতিকথায় সেই ঘটনার বর্ণনা দেন রাজুর বড় ভাই মুনীম হোসেন রানা। এই পদার্থবিদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

স্মৃতিকথায় মুনীম উল্লেখ করেন, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চের দিনটি ছিল শুক্রবার। তখন পবিত্র রমজান মাস। বাবা আমেরিকা থেকে দেশে এসেছেন। পরিবারের সবাই মিলে ইফতার করার রেওয়াজ ছিল। রাজু ছাড়া তারা সবাই ইফতার করছিলেন। এমন সময় বাসায় ফোন এল। খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে তিনি ফোনটা ধরলেন। অপর প্রান্তে আতঙ্কের সুর। বললেন, ‘রানা ভাই, হাসপাতালে আসেন।’ এইটুকু বলেই ফোনটা রেখে দেওয়া হয়। তখন মোবাইল ছিল না। ফিরতি কল করবেন, সেটাও সম্ভব হলো না। কিন্তু তারা নিশ্চিত বুঝে ফেলেন, রাজুর কিছু একটা হয়েছে।

তিন দশক ধরে আন্দোলন-প্রতিবাদের প্রতীক যেন রাজু ভাস্কর্য। ছবি: সংগৃহীত

খবর শুনে বাসা থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়েন মুনীম। বেবিট্যাক্সিতে ওঠার সময় এক বন্ধুকে বলেন মা-বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। শ্যামলী থেকে অল্প সময়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তিনি। জরুরি বিভাগে গিয়ে অনেককে দেখতে পেলেন, যাদের অনেককেই তিনি রাজুর বন্ধু হিসেবে চিনতেন।

তখনো মুনীম জানতেন না, রাজু গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাই তাদের কাছে জানতে চান, ‘কী হয়েছে?’

কিন্তু কেউ কিছু বলছিলেন না। সবাই শুধু সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, রক্তের ব্যবস্থা করছি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক ছিলেন মুনীমের বন্ধু। তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দুজনের রক্তের গ্রুপ এক, আমার রক্ত নিন।’

মুনীমের খালুও হাসপাতালে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে অস্ফুটে বলেন, ‘সম্ভবত ও (রাজু) আর নেই।’ তার কথা শুনে মুনীমের পুরো পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়ায়।

তখন রাত নয়টা-দশটা। রাজুর মৃত্যুর খবর জানাজানি হয়ে গেছে।

হাসপাতালে এক কোণে থাকা রাজুর বাবা শোকে স্তব্ধ। এর মধ্যে পুলিশ তাকে ডেকে মৃতদেহ নেওয়ার নিয়মকানুন বলে। পরে নিয়ম মেনে রাজুকে নিয়ে যাওয়া হয়। মরদেহ দাফনের পর রাজুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পূর্বাপর জানতে পারেন মুনীম।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.