যাকাত- ইসলামিক আর্থিক সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ

যাকাত- ইসলামিক আর্থিক সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ

যাকাত- ইসলামিক আর্থিক সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ

যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক দান ব্যবস্থাপনা, যা মুসলমানদের ওপর ফরজ। যাকাতের উদ্দেশ্য হলো সমাজে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সমাজে সম্পদ পুনঃবণ্টন। এটি ইসলামী অর্থনীতি এবং সমাজের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে, যা একদিকে দানের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি সাধন করে, অন্যদিকে দরিদ্রদের সাহায্য করার মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে।

যাকাতের ফরজ হওয়ার শর্ত

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত পূর্ণ হতে হবে। একজন মুসলমানকে যাকাত দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি বা “নিসাব” থাকতে হবে। নিসাবের পরিমাণের ভিত্তি হিসেবে সোনা বা রূপার পরিমাণ গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে, নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে সাড়ে ৭ তোলা সোনা বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপা বা তার সমপরিমাণ নগদ অর্থ। যদি এই পরিমাণ সম্পদ এক চান্দ্র বছর জমা থাকে এবং ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর অতিরিক্ত থাকে, তবে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে রূপার বাজার দাম অনুযায়ী সাড়ে ৫২ তোলা রূপার মূল্য প্রায় ৫৫ হাজার টাকা।

যাকাতের পরিমাণ

যাকাতের পরিমাণ হচ্ছে সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ, যা “দ্বোনশতাংশ” হিসেবে পরিচিত। নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে এই পরিমাণ অর্থ বা মালামাল যাকাত হিসেবে দান করতে হবে। ব্যবসা বা অন্যান্য উপার্জনের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি যদি নিসাব পরিমাণে পৌঁছায়, তবে সেই পরিমাণের ওপর যাকাত দিতে হবে।

যাকাতযোগ্য সম্পত্তি

সোনা, রূপা এবং গয়না: যাকাতের জন্য সোনা বা রূপা দিয়ে তৈরি গয়না, তৈজসপত্র, ফার্নিচার ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ, তবে তা ব্যবহৃত হোক বা না হোক। এইসব সম্পত্তির বিক্রয়মূল্যের ওপর যাকাত দিতে হবে।

 ব্যবসার মালামাল

ব্যবসার মালামালের ওপর যাকাত ফরজ, যদি এর মূল্য নিসাব পরিমাণে পৌঁছায়। তবে, যাকাতযোগ্য ব্যবসায়িক সম্পদ এবং খরচ বাদ দিয়ে তার ওপর যাকাত প্রদান করতে হবে।

 গৃহস্থালি সামগ্রী এবং যানবাহন

সাধারণত গৃহস্থালি ব্যবহার বা চলাচলের জন্য ব্যবহারিত যানবাহন, বাড়ি, জমি ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ নয়, তবে এগুলির ব্যবসায়িক ব্যবহার বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে তা যাকাতযোগ্য হতে পারে।

 নগদ অর্থ এবং মুদ্রা

দেশের প্রচলিত মুদ্রা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর যাকাত ফরজ, যদি এই মুদ্রার পরিমাণ সাড়ে ৫২ তোলা রূপার সমান হয়।

 শেয়ার এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড

শেয়ার এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা যাকাতযোগ্য। তবে, শেয়ার বাজারের দাম অনুযায়ী যাকাত প্রদান করতে হবে এবং ফান্ডের টাকা যখন উসুল হবে, তখনই তার যাকাত দিতে হবে।

 

নির্দিষ্ট সম্পত্তির যাকাতের নিয়ম-

কৃষিজমি-

কৃষির মাধ্যমে উপার্জিত ফসলের ওপর যাকাত দিতে হবে। যে জমি প্রাকৃতিক উপায়ে সেচিত হয়, তার ফসলের এক দশমাংশ যাকাত দিতে হবে। অন্যদিকে, কৃত্রিমভাবে সেচিত জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের ২০ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে দিতে হবে।

ঋণ-

যদি কারও কাছে অন্যদের থেকে পাওনা টাকা থাকে, তবে সেই টাকার ওপর যাকাত ফরজ হবে, তবে শর্ত হলো, পাওনাদার যদি তা স্বীকার করে এবং আদায়ের অঙ্গীকার করে।

যাকাতের উদ্দেশ্য

যাকাতের মাধ্যমে দরিদ্রদের সাহায্য করা হয়, যা সমাজে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে সাম্য সৃষ্টি করে, যা সমাজের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও উন্নতির জন্য অপরিহার্য। যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি লাভ করে এবং সমাজে সুখ-সমৃদ্ধির উৎস হিসেবে কাজ করে।

পয়েন্ট আকারে কিছু বিষয় আলোচনা দেওয়া হলো

যাকাতের জন্য অযোগ্য সম্পত্তি

জমি, বাড়ি-ঘর, দালান, দোকান, কারখানা, যন্ত্রপাতি, অফিস ও ঘরের আসবাবপত্র, ব্যবহারিক যানবাহন, চলাচলের পশু, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, গৃহপালিত পশু-পাখি ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ নয়।

সোনা এবং রূপার ওপর যাকাত

সোনা বা রূপার তৈরি গয়না, তৈজসপত্র, ফার্নিচার ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ, তা ব্যবহৃত হোক বা না হোক। গয়নার ক্রয়মূল্য নয়, বিক্রয়মূল্যের ওপর যাকাত দিতে হবে।

ব্যবসার মালের ওপর যাকাত

ব্যবসার মালের ওপর যাকাত ফরজ, যদি এর মূল্য সাড়ে ৭ তোলা সোনা বা সাড়ে ৫২ তোলা রূপার সমান হয়। খামারে পালিত গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মাছ, পোনা, নার্সারি, বীজ, চারা, হাউজিং ব্যবসার জমি, প্লট, ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট বা প্রাপ্ত বাড়ি-ভাড়ার ওপরও যাকাত দিতে হবে।

ব্যবসার দেনা থেকে যাকাতের পরিমাণ বাদ যাবে

যদি ব্যবসার দেনা (যেমন বাকিতে মালামাল, কাঁচামাল ক্রয়, বেতন/মজুরি, ভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস ইত্যাদি) পরিশোধিত না থাকে, তবে ওই পরিমাণ অর্থ যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে।

মুদ্রা ও বৈদেশিক মুদ্রা

দেশে প্রচলিত মুদ্রা (টাকা, পয়সা, নোট) এবং বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার, পাউন্ড, রিয়াল, দিরহাম) ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ, যদি সেগুলোর পরিমাণ সাড়ে ৫২ তোলা রূপার সমান হয়। যে জিনিসগুলোতে সোনা বা রূপা অধিক, তা সোনা বা রূপা হিসেবেই গণ্য। মুদ্রা ও গয়না ইত্যাদি যে সকল জিনিসে সোনা বা রূপার পরিমাণ অধিক, সেগুলো সোনা বা রূপা হিসেবেই গণ্য হবে। এতে ব্যবহৃত সোনা বা রূপা থেকে খাদ বাদ দিয়ে যাকাত দিতে হবে।

অন্যের কাছ থেকে পাওনা টাকার ওপর যাকাত

যদি দেনাদার স্বীকার করে এবং তা আদায়ের অঙ্গীকার করে অথবা নথিপত্র দ্বারা প্রমাণিত থাকে, তবে অন্যের কাছ থেকে পাওনা টাকার ওপর যাকাত ফরজ।

প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা

প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কেবল তখনই যাকাতযোগ্য হবে, যখন তা উসুল করা হবে।

কোম্পানির শেয়ারের ওপর যাকাত

কোনো কারখানা বা কোম্পানির শেয়ার মূল্যের ওপর যাকাত ফরজ। তবে এর যে অংশ কলকব্জা ইত্যাদির জন্য খরচ হয়েছে, তার ওপর যাকাত দিতে হবে না।

যাকাতযোগ্য সম্পদের একত্রিত পরিমাণ

যাকাতযোগ্য বিভিন্ন প্রকারের সম্পদ (সোনা, রূপা, নগদ টাকা, পণ্যদ্রব্য বা শেয়ার ইত্যাদি) এককভাবে যাকাতযোগ্য পরিমাণে না হলেও, যদি সব মিলিয়ে নিসাব পরিমাণ হয়, তবে যাকাত ফরজ।

ফসলের ওপর যাকাত (ওশর)

যাদের ২৮ মণ ৫ সের ফসল আসে, তাদেরকে ওশর বা এক দশমাংশ ফসল যাকাত হিসেবে দিতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে সেচিত জমির ফসলের ১০% এবং কৃত্রিমভাবে সেচিত জমির ফসলের ৫% যাকাত দিতে হবে।

ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা

যারা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা রেখেছেন, তাদেরকেও নিসাব পরিমাণে পৌঁছলে যাকাত দিতে হবে।

ঋণের তুলনায় নগদ টাকা বেশি হলে যাকাত

যদি ঋণের তুলনায় নগদ টাকা বেশি থাকে, তাহলে ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বাদ দিয়ে বাকি টাকার ওপর যাকাত দিতে হবে।

যাকাতযোগ্য অলংকার কিন্তু নগদ অর্থ নেই

যদি যাকাতযোগ্য অলংকার থাকে কিন্তু নগদ অর্থ না থাকে, তাহলে অলংকার বিক্রি করে তার সমমূল্যে যাকাত প্রদান করতে হবে।

কাফফারা, মানত বা হজের টাকা

যদি কাফফারা, মানত বা হজের জন্য জমাকৃত টাকা নিসাব পরিমাণে হয়, তবে তার ওপরও যাকাত ফরজ।

স্ত্রীর মোহরের টাকা এবং কোরবানির টাকা

স্ত্রীর মোহরের জমাকৃত টাকা এবং কোরবানির জন্য জমাকৃত টাকার ওপরও যাকাত দিতে হবে।

সরকারকে ট্যাক্স বা আয়কর দেয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত আদায় হবে না । সরকারকে ট্যাক্স বা আয়কর দেয়ার সময় যাকাতের নিয়ত করলে তাতে যাকাত আদায় হবে না, কারণ সরকার তা যাকাত হিসেবে বা শরীয়ত নির্ধারিত খাতেও ব্যয় করে না।

ব্যাংক ঋণ নেয়ার পরও যাকাত

শিল্পস্থাপন বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরও যদি যাকাতযোগ্য পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ থাকে, তবে যাকাত দিতে হবে।

নিয়ত না করে দান করলে যাকাত হবে না

যাকাত ফরজ হয়েছে এমন সকল সম্পদের মূল্য হিসাব করে, 2.5% (অথবা এক চতুর্থাংশ) পরিমাণ অর্থ যাকাত দিতে হবে, তবে নিয়ত না করলে তা যাকাত হিসেবে গণ্য হবে না।

যাকাতের পরিমাণ

যাকাতের পরিমাণ হলো ২.৫% (এক চতুর্থাংশ) সম্পদের মোট মূল্য থেকে, ঋণ পরিশোধের পর।

যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান, যা মুসলমানদের ওপর আর্থিক দানে উৎসাহিত করে। এটি শুধু ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের একটি কার্যকর উপায়। মুসলমানদের উচিত, যাকাতের নিয়মাবলি সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং এই ফরজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা।

 

 

 

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.