মৌ-চাষে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি, ঘুচছে বেকারত্ব

করোনাভাইরাস মহামারির সময় বেশ খারাপ সময় কাটছিল সিরাজগঞ্জের গাড়ুদহের তাঁত শ্রমিক শাহাদাত হোসেনের। পরে অনেকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে শুরু করেন মৌ চাষ। এতে সাফল্যও আসে ঘরে। এখন তার কাজ সরিষা খেত ও আম-লিচু বাগানকে ঘিরে।

এলাকায় ‘মধু শাহাদাত’ নামে পরিচিত ৫৮ বছর বয়সী এই ব্যক্তি প্রতি বছর সরিষা খেতে মৌমাছির বাক্স বসান। প্রতি বাক্সে এক ঝাঁক মৌমাছি থাকে। এর মধ্যে একটি রানি মৌমাছি ও প্রায় ৮০০ থেকে ১২ শ কর্মী মৌমাছি।

শাহাদাত জানান, রানি মৌমাছি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিম দেওয়ার পাশাপাশি ফেরোমোন উত্পাদন করে মৌচাক নিয়ন্ত্রণ করে। মৌমাছিরা ‘কুইন গেট’ নামে ফাঁকা জায়গা দিয়ে চলাচল করে।

শাহাদত মৌমাছিদের চলাফেরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। প্রতি আট দিন পরপর বাক্সগুলোকে সরিষা খেতের নতুন নতুন দিকে নিয়ে যান। তিনি কাজ করার সময় অস্থায়ী তাঁবুতে থাকেন।

গত সপ্তাহে তিনি ৬৫ কেজি মধু সংগ্রহ করলেও ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে চলতি সপ্তাহে তা কমে ৩৭ কেজি হয়েছে।

শাহাদাত তার উৎপাদিত মধু কেজিপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি করে প্রতি মৌসুমে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা আয় করেন।

মধুর বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি গ্রামে ২৪ শতক জমি কিনেছেন।

তার ভাষ্য, ‘নিজের বাড়ি ছিল না। এতদিন কালিদাসগাতীতে শ্বশুর বাড়িতে থাকতাম। এখন আমি গাড়ুদহে জমি কিনেছি। বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করছি।’

গান্ধাইলের মেহেদী হাসান মুরাদের মতো অনেক ক্রেতা শাহাদাতের মধু কেনার অপেক্ষায় থাকেন। তার কাছ থেকে পাওয়া মধু দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়।

শাহাদাতের পরিকল্পনা মৌসুমের বাকি সময় যমুনা নদীর পূর্ব তীরের চরাঞ্চলে গিয়ে থাকা। এরপর লিচু ফুলের মধুর জন্য ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর যাওয়া। তিনি ইতোমধ্যে মধু জোগাড় করতে লিচু বাগানের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

মধু উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা জেলা সিরাজগঞ্জে উর্বর কৃষিজমি ও সরিষা খেত আছে।
জানা গেছে, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। এই তিন মাস দেশজুড়ে সরিষার খেতগুলো বন্য ও পালিত মৌমাছির চারণভূমিতে পরিণত হয়। হলুদ এই ফুলের আকর্ষণে মৌমাছির দল শশব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারাদিন ফুলে ফুলে বিচরণ করে সংগ্রহ করে পুষ্পরস। পুষ্পরস হচ্ছে মধু তৈরির প্রধান উপকরণ।

এই পুষ্পরস থেকে পাওয়া মধু সংগ্রহ করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। অবদান রাখেন গ্রামীণ অর্থনীতিতে। অন্যদিকে, ফুলের পরাগায়ণের মাধ্যমে মৌমাছি কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।

কাজটি শ্রম-ঘন হলেও মৌ-পালন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয়ের ভালো উৎস। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে মধুর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। সে হিসাবে গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই মৌ-পালন।

তবে এই শিল্পেও সংকট আছে। অনিশ্চিত আবহাওয়ার বিরুদ্ধে মৌমাছি পালকদের লড়াইয়ের পাশাপাশি মৌমাছির পরিবেশগত গুরুত্ব সম্পর্কে প্রতিনিয়ত শিখতে হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, সাতক্ষীরা, খুলনা, বগুড়া, নওগাঁ, মাগুরা, সিলেট, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে সরিষা, কালোজিরা, লিচু, আম, সূর্যমুখী, জলপাই ও বরইসহ অন্যান্য ফল-ফসলের ফুল থেকে বাণিজ্যিকভাবে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে।

গ্রামাঞ্চলে অনেক কৃষক ও মৌমাছি পালনকারী সরাসরি মধু উৎপাদনে জড়িত। তাদের আনুমানিক সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজার। তবে সরবরাহ ব্যবস্থার নানান পর্যায়ে মধু উৎপাদন ও বিপণনে জড়িতদের কথা বিবেচনা করলে আনুমানিক সংখ্যা দাঁড়ায় ৯০ হাজার।

বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন ও কৃষি জরিপে জানা যায়, দেশে বছরে আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন মধু উৎপাদিত হয়। এর বেশিরভাগই সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে আসে। তবে গ্রাম ও মফস্বলে মৌমাছি পালনের কয়েকটি কাঠামোগত পদ্ধতি আছে।

ধারণা করা হয়, দেশে বছরে মধু ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টন। বিশেষ করে, ঢাকায় ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সচেতন জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মধু কেনেন।

দেশে গড়ে মাথাপিছু মধু ব্যবহারের পরিমাণ তুলনামূলক কম। দেশে বছরে মাথাপিছু মধু ব্যবহার হয় প্রায় ১০০ গ্রাম। পশ্চিমের দেশগুলোর তুলনায় তা অনেক কম।

নগরায়ণ, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক মিষ্টির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কারণে প্রতি বছর মধুর ব্যবহার পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে দেশে ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ২৫ হাজার ১৭১ লাখ হেক্টর জমিতে মধু সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

মৌমাছি সাধারণত সরিষা ফুলের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। শুধুমাত্র পরাগ ও খাবারের উত্স হিসেবে নয়, সরিষা ফুল থেকে মৌমাছিরা সহজে মধু সংগ্রহ করতে পারে। এ বছর ৯৩ হাজার ৪৭৮টি মৌমাছির বাক্স বসানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশা, এ থেকে ১৫ লাখ কেজি মধু পাওয়া যেতে পারে।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এ জেড এম আহসান শহীদ সরকার জানান, এ বছর জেলায় সরিষার আবাদ বেড়ে হয়েছে ৮৭ হাজার ১২৫ হেক্টর। গত বছর ছিল ৮৫ হাজার ১৭০ হেক্টর। উচ্চ ফলনশীল সরিষার জাত বারি-১৪ কৃষকদের সবচেয়ে পছন্দের। এখানকার মাটিতে এই জাতের সরিষা ভালো হয় বলে এটি এখন বেশ জনপ্রিয়। সরিষা চাষ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর ৪০০ টন মধু পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। গত বছর পাওয়া গিয়েছিল ৩৮২ টনের একটু বেশি।

তবে মৌমাছি পালন সহজ কাজ নয়। দীর্ঘ সময়, প্রতিকূল আবহাওয়া ও মৌসুমি অনিশ্চয়তা এটিকে সংকটময় পেশায় পরিণত করেছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মতো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও মৌমাছি পালনের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ, সহায়তা ও সচেতনতার মাধ্যমে দেশে মৌমাছি পালনের ভবিষ্যৎ আশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে। তবে, অনুকূল পরিবেশ, প্রশিক্ষণের সহজলভ্যতা ও মধুর ক্রমবর্ধমান চাহিদা সত্ত্বেও মৌমাছি পালনকারীরা বেশকিছু সংকটে পড়েন। একটি প্রাথমিক সমস্যা হলো কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাঈদী রহমান বলেন, পরাগায়ণের সুফল পাওয়া সত্ত্বেও অনেক কৃষক এখনো মৌমাছিকে ফসলের জন্য হুমকি মনে করেন। এমন অনেকে আছেন যাদের ধারণা মৌমাছি ফসলের ক্ষতি করে। অথচ মৌমাছির পরাগায়ন ফলে ফলন ১৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।

এমন ভুল ধারণা দূর করতে, কৃষকদের মৌমাছি পালন ও ফসল উৎপাদনে মৌমাছির ভূমিকা তুলে ধরতে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.