ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সফরে এসেছিলেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল। সফরকালে তিনি বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা। আর দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল স্বাভাবিক কার্যক্রমেরই অনুসরণ। উল্লেখ্য, গত বছর ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে গঠিত ১৯ দলের কোয়ালিশন সরকারের একজন মন্ত্রীর এটিই ছিল বাংলাদেশে প্রথম সফর।
৫ ফেব্রুয়ারি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী এবং সফররত মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর তাঁরা উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী মালয়েশিয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে—ক. তাঁদের দেশের কর্মী চাহিদা পূরণ করা, খ. কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং গ. মালয়েশিয়ায় কর্মরত বিদেশি কর্মীদের সম্মান সংরক্ষণ। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যে খুবই ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে এবং ওই বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুই দেশের প্রতিনিধিরা শিগগিরই বৈঠকে বসবেন ও মালয়েশিয়ার আগের সরকারের সময় করা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নিয়ে আলোচনা করবেন। ওই স্মারকে যেসব পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হবে সেগুলো পরিবর্তন করা হবে। তবে আমরা অতীতে যেমনটি দেখেছি, তাতে মনে হয় যে দুই দেশের সম্মতিতে একটি নতুন সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হতে পারে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী আভাস দেন যে কর্মী নিয়োগে সামনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা। মালয়েশিয়ার আগের সরকারের সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তাতে পরিবর্তন আসবে। এমওইউতে পরিবর্তন আনা নিয়েও কথা উঠেছে। বাংলাদেশ ভালো কিছু পাওয়ার আশা করে। দুই দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের মধ্যে বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনা হবে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ ছাড়া তিনি রিক্যালিব্রেশনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, এই সুযোগ গ্রহণ করে যেসব বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন বা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তাঁরা বৈধভাবে কাজ করতে সক্ষম হবেন।
আমরা জানি, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন নতুন জোট সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরালো করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার সপ্তাহখানেক আগে ইন্দোনেশিয়া সফর করে এসেছেন এবং এ মাসের শেষ দিকে সিঙ্গাপুর ও ব্রুনেই সফরে যেতে পারেন। ইন্দোনেশিয়া সফরকালে দুই দেশের মধ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা জোরদার করার ব্যাপারে উভয় দেশ সম্মত হয়। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি অভিবাসী শ্রমিক ইন্দোনেশিয়ার, বিশেষ করে গৃহকর্মী। অতীতে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে দুই দেশের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি জাকার্তায় মালয়েশিয়ার দূতাবাস আক্রান্ত হয়েছিল এবং ইন্দোনেশিয়া গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী নেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল এবং আমরা নানা কারণেই ওই প্রস্তাবে সাড়া দিইনি। যাই হোক, পরিস্থিতি সামাল দিতে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিবকে ছুটে যেতে হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার নেতাদের কাছে। তবে এবার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারের সফরে উভয় পক্ষ আরেকটি বিষয়ও নিশ্চিত করেছে যে কোনো অবস্থায়ই কর্মসংস্থান প্রতিষ্ঠানগুলোকে অভিবাসী কর্মীদের শোষণ করে উচ্চ মুনাফা করতে দেওয়া হবে না।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়ার বিষয়টি নিয়েও প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি তিনি নেপালের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে নেপাল কম খরচে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করতে পারলে বাংলাদেশের কর্মীদের এত বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেন। বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়ায় জড়িত এজেন্টদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যাই হোক, তিনি এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা বলেছেন। ধারণা করা যায়, দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের আসন্ন বৈঠকে অভিবাসন ব্যয় হ্রাসের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই মানবিক বিবেচনা আমাদের কর্মীদের মনে অবশ্যই নতুন করে আশার আলো দেখাবে, যদি দুই দেশের নেতারা অভিবাসীদের চাওয়া-পাওয়াকে অনুভব করেন।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণের এক ব্যতিক্রমী ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল ২০১২ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত ‘জিটুজি’ পদ্ধতির সমঝোতা স্মারকটির মাধ্যমে (অভিবাসন ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার টাকার কম)। তবে ওই স্মারকটি ২০১৬ সালে একটি সুবিধাবাদী চক্রের স্বার্থে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। ‘জিটুজি প্লাস’ নামের প্রতিস্থাপিত ওই স্মারকের অধীন মাত্র ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি হয়ে বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণ চলতে থাকে। মালয়েশিয়ায় সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই ২০১৮ সালের মে মাসে ওই সিন্ডিকেটের শোষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে স্থানীয় দৈনিক ‘দ্য স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ : মালয়েশিয়া জিটুজিতে ফিরে যেতে চায়’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ার তৎকালীন মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান বলেছিলেন, ‘আমরা জিটুজি প্লাস চাই না। যেকোনো ব্যবস্থাই হতে হবে সরকার থেকে সরকার।’ আর ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এরপর ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর মালয়েশিয়া থেকে ফিরে এসে আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ডাটাবেইস থেকে কর্মীদের পাঠানো হবে এবং অভিবাসনের খরচ একজন শ্রমিকের দুই থেকে তিন মাসের বেতনের বেশি হবে না। দুই পক্ষ কোনো ধরনের গ্রুপিং বা সিন্ডিকেট করতে দেবে না। সে সময় উভয় পক্ষের প্রকাশিত অনুভূতি এতটাই প্রশংসনীয় ছিল যে তা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক আমাদের দরিদ্র কর্মীদের হৃদয়কে স্পর্শ করে গিয়েছিল।
কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সেটি আর দেখা গেল না। আসলে উভয় প্রান্তের অবদানেই দুর্নীতির একটি বড় আখড়ায় পরিণত হয়েছে এই সেক্টর। দুঃখজনক হলো, দরিদ্র বিদেশগামী কর্মীদের স্বার্থের কথা কেউ ভাবে না। তাহলে আমরা কি কোনো দিনই অভিবাসীকর্মী ও রিক্রুটিং এজেন্সির স্বার্থ সঠিকভাবে রক্ষা করে একটি অভিবাসীবান্ধব নিয়োগব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে পারব না? সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করায় আমাদের আত্মসম্মান কি একটুও ক্ষুণ্ন হয় না? মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কি বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য চিরকাল সিন্ডিকেটের শোষণের হাতিয়ার হয়েই রয়ে যাবে?
আমরা যদি এই বিষয়ে কোনো ইতিবাচক উন্নতি দেখতে প্রত্যাশা করি, তাহলে সেটিকে হতে হবে একটি দ্বিমুখী পদক্ষেপ। মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ উভয়েরই এই ইস্যুটি যৌথভাবে মোকাবেলা করতে হবে, যাতে তথাকথিত ‘আদম ব্যবসা’ নামের শোষণকে বন্ধ করা যায়। মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকারের লক্ষ্য সত্যিকার অর্থে যদি অভিবাসন ব্যয় কমানো এবং বিদেশি কর্মীদের সম্মান রক্ষা হয়ে থাকে, আর আমাদের সরকার যদি আমাদের কর্মীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, তাহলে একটি অভিবাসী কর্মীবান্ধব নিয়োগপ্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন কাজ নয়। আর তেমনটি করা গেলে সেটিই হতে পারে এ ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী প্রক্রিয়া, যা দুই দেশের বন্ধুত্বকে সুদৃঢ়ই করবে না, দুই দেশের জনগণকে আরো কাছে টেনে নেবে এবং দুই দেশ ও তাদের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।
আমার জানা মতে, বাংলাদেশের কর্মীরা যে নানাভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, তা প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ভালোভাবেই অবগত আছেন। আশা করা যায়, তিনি এই কর্মীদের প্রতি তাঁর মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাঁদের খেলা খেলেই যাবেন, আমাদের সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যাই হোক, সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে অবশেষে মালয়েশিয়ার নতুন সরকারের কাছ থেকে আমরা চমৎকার কিছু পাওয়ার আশা করতে পারি। একই সঙ্গে দেশের মঙ্গলের জন্য আমাদের সরকারকেও এ ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব