ডায়েরি কি সত্যিকারভাবেই নিজেকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেয়? ‘ভিতরে একটা লোক প্রতিদিন সংসারের উপর নানা চিন্তা, নানা কাজ গাঁথিয়া গাঁথিয়া এক অনাবিষ্কৃত নিয়মে একটি জীবন গড়িয়া চলিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে ডায়ারি লিখিয়া গেলে তাহাকে ভাঙিয়া আর-একটি লোক গড়িয়া আর-একটি দ্বিতীয় জীবন খাড়া করা হয়।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশকিছু ভ্রমণসংক্রান্ত গ্রন্থের নামকরণে ‘ডায়ারি’ শব্দটি ব্যবহার করলেও ডায়েরি লেখার পক্ষে ছিলেন না, লেখেননি, যদিও চিঠিপত্র রচনায় তিনি অবিস্মরণীয়। ‘ডায়ারি’ লেখায় তাঁর আপত্তি মূলত দুটি—‘কতকটা জীবন অনুসারে ডায়ারি হয়, কতকটা ডায়ারি অনুসারে জীবন হয়।’ কিন্তু এর কোনোটাকে না মেনে, ‘দ্বিতীয় জীবন’ খাড়া করার কৃত্রিম প্রয়াস না পেয়ে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বারোটি ডায়েরি ‘রেখে যান বলা ভুল, বলা উচিত ফেলে যান’, ডায়েরি-সাহিত্য রচনায় মোটেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নয়; এর কোনোটি সাহিত্যও হয়ে ওঠেনি। এর একটিও পরিকল্পনামাফিক নয়, ডায়েরির সন-তারিখ বছর অনুযায়ী নয়, এক বছরের ডায়েরিতে অন্য বছরের ডায়েরি বা দুটো বছর মিলিয়ে একটি ডায়েরি। জীবনের, সাহিত্যের যদি সুবর্ণযুগ বলতে হয়, পেরিয়ে এসেছেন। ব্যক্তিগত জীবন (১৯০৮-’৫৬), লেখকজীবনের (১৯৩৫-’৫৬) শেষ বারো বছরে (১৯৪৫-’৫৬) যেন জমা হলো নানা মাসের বারোখানা ডায়েরির কৌটো।
যুগান্তর চক্রবর্তী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত কাগজপত্র, চিঠিপত্র ইত্যাদির সঙ্গে এ ডায়েরিগুলোর চেহারা-ছবির বর্ণনা দিয়েছেন: ‘রঙচটা, তোবড়ানো, মরচেধরা গোটা তিন-চার মাঝারি আকারের টিনের তোরঙ্গ ভর্তি স্তূপাকার ছিন্ন পাতা, ছোটবড় কিছু খাতা ও নানা মাপের বারোখানা ডায়েরি—।’ এ বারোটি ডায়েরির সময়সীমা ১৯৪৫-১৯৫৬, শুরু ২৩ অক্টোবর ১৯৪৫, শেষ ২৪ নভেম্বর ১৯৫৬। এর পরে কবিতার খাতায় পাওয়া যায় পরপর চার দিনের সংসার-খরচের হিসাব, ২৮ নভেম্বর ১৯৫৬ তারিখে তাঁর লেখা। এর পরেও ২৯ নভেম্বর ১৯৫৬-এ তিনি লেখেন আবারও সংসার-খরচের হিসাব। এটি একাধারে তাঁর সংসার খরচের শেষ হিসাব ও তাঁর হস্তাক্ষরের শেষ নিদর্শন।
এগুলোর মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও সাহিত্যের প্রধানত যে দিকগুলো উঠে এসেছে তা হলো : বিশৃঙ্খল জীবনে সুশৃঙ্খল ডায়েরি রাখার প্রয়োজন-অনুভব নয়; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বিলম্বিত’ না বলে বলতে পারি, ‘বিড়ম্বিত’ হয়েই যেন প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা-যন্ত্রণার দিনলিপি এঁকে গিয়েছেন। জীবনের প্রান্তদেশের হলেও এগুলোর মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে তাঁর ১৯৩৫-এ প্রথম (মতান্তরে ১৯৩৬) মৃগীরোগের আক্রমণ এবং তাঁর প্রথম গ্রন্থাকারে মুদ্রিত উপন্যাস ‘জননী’ (মার্চ ১৯৩৫) থেকে তাঁর পরবর্তী রচনাবলির প্রকাশ, ১৯৪৪ থেকে আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টিতে সদস্যপদের ধারাবাহিকতা। যে বারোটি ডায়েরি, এগুলোর উপলক্ষ্য ছিল বিভিন্নজনের কাছ থেকে উপহারস্বরূপ প্রাপ্ত বিভিন্ন বছরের ডায়েরি ‘প্রতি নতুন বছরে নতুন ডায়েরী হাতে পেয়ে ডায়েরী লেখার সাধ। দেখা যাক এবার হয় কিনা!’ অবশ্য এর বছর তিন আগেও ডায়েরি রাখার ক্ষেত্রে ছিল তাঁর নেতিবাচক মনোভাব ‘এবারও কি সুরুতেই শেষ হবে? দেখা যাক, ডায়েরী রাখতে পারি না কেন? বোধ হয় এই ধারণা থেকে গেছে বলে যে ডায়েরী মানেই নিছক ব্যক্তিগত কথা! কয়েকদিন লেখার পর আর উত্সাহ পাই না।’ এর পরেও তিনি ডায়েরি লিখতে চেয়েছিলেন এবং বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও নিয়মিতভাবে। ‘অনেকদিন লেখা হয়নি। বড় অসময় চলছিল—এর মধ্যে এসেছিল চরম অবস্থা। অন্য মানুষ ডুবে যেত!’ এক বছরের ডায়েরি-র খাতায় অন্য বছরের ডায়েরি লিখে গেছেন, যে বছর-দিন-তারিখে লিখছেন তার উল্লেখ করে, অর্থাত্ পারম্পর্যহীন; যেমন ১৯৪৫-এর ডায়েরিবুকে ১৯৫১-এর পর ১৯৫০, আবার ১৯৫১; ১৯৫২-’৫৩-এর দুটি তারিখের পর ১৯৪৫-’৪৭, এর পর আবারো ১৯৪৫। যখন যে ডায়েরির, মাঝে-মধ্যে বাদ পড়ে যাওয়া, সাদা পাতাগুলো পেয়েছেন, সেগুলোতে নোট রেখেছেন। এ নোটগুলোই মূলত তাঁর ডায়েরি। ১৯৪৫-’৫৬, এই বারো বছর সময়ের প্রতিটি বছর এক-একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় গণ্য করে বারোটি ডায়েরির বার্ষিক সূচিক্রম : ৪৫। ১৯৪৬ (১৯৪৬-৪৭)। ১৯৪৭। ১৯৪৮। ১৯৪৯। ১৯৫০। ১৯৫১। ১৯৫২। ১৯৫৩। ১৯৫৪। ১৯৫৫। ১৯৫৬।
(ক) তাঁর গল্প-উপন্যাসের প্লট ও চরিত্র পরিকল্পনা; (খ) পরিবর্তনের খসড়া; (গ) সংসার-খরচার হিসাব; (ঘ) পরিবারিক টানাপোড়েন; (ঙ) সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্যিক ঘটনা, পরিবেশ ও তাঁর নিজস্ব মতামত, প্রতিক্রিয়া; (চ) চলচ্চিত্র প্রযোজকের সঙ্গে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর; (ছ) বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে গ্রন্থস্বত্বের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি; (জ) ব্যক্তি-মানসিকতা, চিকিত্সা-সংকট, মদ্যপান, সংযম-চেষ্টা, সজীব নিয়মমাফিক জীবনের পরিকল্পনা ও ব্যর্থতা, দারিদ্র্য; (ঝ) শেষ অসুস্থতা, হাসপাতাল-জীবন; (ঞ) ‘মায়ের দয়া’, ‘মা’ (অতিলৌকিক অর্থে ব্যবহূত হলেও ‘বিপর্যস্ত শেষজীবনের অতিগোপন মানসিক আশ্রয় ও নিরাপত্তার শব্দগত প্রতীকমাত্র’)।
মানিকের লেখালেখি যে তাঁর জীবনের প্রথম থেকেই পরিকল্পিত ছিল এমন মনে করা যেতে পারত যদি তিনি সে সময় ডায়েরি লিখতেন। উপন্যাসে না লিখে ডায়েরিতে নোট রাখতেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র কুমুদ মতি উপাখ্যানে আপাত ইতি টেনে ‘…ওদের কথা এইখানেই শেষ হইল। যদি বলিতে হয় ভিন্ন বই লিখিয়া বলিব।’ (পুতুলনাচের ইতিকথা, একাদশ পরিচ্ছেদ) কিন্তু ডায়েরি লেখার সময় থেকে তা পাকাপাকি নিয়মিত। ‘তোমরা সবাই ভালো’, ‘বেড়া’ গল্প, উপন্যাস ‘ডাক্তারবাবু’ (পরিবর্তিত, পরিণত রূপ ‘পেশা’) ‘আপশোষ’ (পরিণত রূপ ‘ছিনিয়ে খায়নি কেন?’), গল্প ‘রাসের মেলা’, ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’, ‘চক্রান্ত’, উপন্যাস ‘চিহ্ন’, গল্প ‘ধানের গোলার ধান’, ‘হারানের নাতজামাই’, তাঁর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘ভিটেমাটি’, উপন্যাস ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ (পূর্বনাম ‘নগরবাসী’), ‘সোনার চেয়ে দামী’ (প্রথম খণ্ড ‘বেকার’, দ্বিতীয় খণ্ড ‘আপোষ’), গল্প ‘পাশফেল’, ‘ফেরিওলা’, উপন্যাস ‘অহিংসা’ (দ্বিতীয় ভাগ); গল্প ‘ছোট একটি গল্প’ (অদ্যাবধি অগ্রন্থিত); উপন্যাস ‘হরফ’; ছোটদের গল্প ‘কাণ্ডকারখানা’ (তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশ); উপন্যাস ‘শুভাশুভ’, ‘প্রাণেশ্বরের উপখ্যান’, ‘হলুদ নদী সবুজ বন’, ‘মাঝির ছেলে’ (তাঁর একমাত্র কিশোর উপন্যাস); অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘একটি চাষীর মেয়ে’; কিশোরপাঠ্য গল্প ‘অলৌকিক লৌকিকতা’ ইত্যাদি তাঁর পরিচিত-অপরিচিত অনেক রচনার বিচিত্র প্লট-চরিত্রের খসড়া, এগুলোর পরিবর্তন-পরিমার্জনের (রচনাকালে ক্রমানুসারে) একমাত্র সাক্ষী হয়ে আছে তাঁর বারোটি ডায়েরির পাতা।