মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি
মাতারবাড়ি, যা ছিল কক্সবাজার জেলার মহেশখালী দ্বীপের অনেকটা অপরিচিত একটি জায়গা। দেশের ক’জন মানুষ শুনেছিল এ জায়গাটির নাম? কিন্তু একদা অপরিচিত এ মাতারবাড়িই হতে যাচ্ছে অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। জাপানের ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা বিগ-বি ধারণায় বদলে যাচ্ছে মহেশখালী। সেখানে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে শুধু মাতারবাড়িই বদলাবে না, এই মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি। ব্যস্ততম চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ সম্পাদিত হলেও এ বন্দরের জাহাজগুলোকে ব্যবহার করতে হয় অন্য দেশের ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট। কারণ বড় জাহাজগুলো চট্টগ্রামে ভিড়তে পারে না। মাতারবাড়িতে হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর, যেখানে ভিড়তে পারবে ১৬-১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। অর্থাৎ সবচেয়ে বড় জাহাজটিও নোঙ্গর করতে সক্ষম হবে এই বন্দরে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ নিজেই হবে একটি ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টের মালিক। এতদিন বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে অন্য দেশের বন্দর। আর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর হবে রিজিওনাল পোর্ট, যা সেবা দিতে পারবে আশপাশের দেশগুলোকে।
সরেজমিনে মাতারবাড়ি ঘুরে দেখা যায় সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া দৃশ্যপট। সেখানে তৈরি হয়ে গেছে জাপানের সহায়তায় ১২শ’ মোগওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা এখন উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায়। কয়লার জেটি তৈরি করতে যে চ্যানেল করা হয়েছে তার সম্প্রসারিত রূপই হবে গভীর সমুদ্রবন্দর। বিশাল এলাকাজুড়ে উন্নয়নযজ্ঞ। একদা যেখানে লবণের মাঠ ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না, সেখানে এখন অত্যাধুনিক স্থাপনা। কর্মসংস্থান এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অনেক। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি চালু হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখো মানুষ খুঁজে পাবে তাদের জীবিকার সন্ধান। সে কারণে এলাকার মানুষও দারুণ উৎফুল্ল। মাতারবাড়িকে কেন্দ্র করে রেলপথ ও প্রশস্ত সড়ক হচ্ছে। এর মাধ্যমে ঘটছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হাকিম মিয়া বলেন, গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন। প্রকল্পগুলো শেষ ও চালু হলে মাতারবাড়ি হবে রিজিওনাল হাব। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ আসবে। বাংলাদেশের প্রতি বিদেশীদের আকর্ষণ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের তিনি জানান, গত বছরে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে বিডা। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত চার মাসে ৩৮ জন বিদেশী রাষ্ট্রদূত তার সঙ্গে দেখা করেছেন। ২২৫টি বিদেশী টিম বাংলাদেশ পরিদর্শন করেছে। বাংলাদেশ এখন আগ্রহের জায়গায় পরিণত হয়েছে জানিয়ে বিডা চেয়ারম্যান বলেন, পৃথিবীর এ অঞ্চলে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বসবাস। আমাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আমাদের সঙ্গে আশপাশের সকল দেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য খুবই উপযুক্ত এবং আকর্ষণীয় স্থান। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে অনেক বিনিয়োগকারী আসবেন। এখনই মাতারবাড়িতে সাড়ে ৩-৪ হাজার বিদেশী কাজ করছেন। বন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপারেশনে গেলে শিল্পায়ন হবে, দেশী-বিদেশী কর্মসংস্থান আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মাতারবাড়ি এলাকা পরিদর্শন করেন। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। মাতারবাড়িতে চলমান কাজগুলো সমন্বিত উন্নয়ন।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের জানান, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের কাজ শেষ। এর মধ্যেই গত ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি ৪শ’ কেবি বিদ্যুৎ লাইন সংযুক্ত করা হয়েছে। আগামী এপ্রিলের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি হবে ৮০ হাজার টন কয়লা। এ কয়লা আসার পর আমরা উৎপাদনে চলে যাব। জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে মাতারবাড়ির বিদ্যুৎ। উৎপাদনে যেতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে বলে তিনি জানান।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান গভীর সমুদ্রবন্দরের অগ্রগতি প্রসঙ্গে বলেন, ২০২৬-২৭ সালের মধ্যে এ বন্দর চালু হবে। এখানে ১৬-১৮ মিটার ড্রাফটের ৩শ’ মিটার লম্বা বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। একসঙ্গে পরিবহন করা যাবে ১০-১২ হাজার টিইইউএস কন্টেনার পণ্য। আমাদের আমদানি-রপ্তানির পণ্যগুলো আর ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট-নির্ভর হবে না। সরাসরি চলে যেতে পারবে গন্তব্যে। তিনি জানান, এরই মধ্যে ইতালির রেভেনা বন্দরসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের পণ্য সরাসরি যাচ্ছে। পর্তুগালসহ আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ যোগাযোগের প্রক্রিয়া চলছে। বড় জাহাজে একসঙ্গে বেশি পণ্য এলে এবং সরাসরি পণ্য পাঠাতে পারলে বন্দরে জাহাজের অপেক্ষার সময় কমে যাবে। তিনি আরও জানান, এরই মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দরে প্রকল্পের পণ্যবাহী ১১৭টি জাহাজ ভিড়েছে। এতে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের মে মাসে জাপানের টোকিওতে শীর্ষ বৈঠকের সময় সেদেশের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জাপান-বাংলাদেশ ব্যাপক অংশীদারিত্বের ধারণায় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদারে সম্মত হন। সে বৈঠকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ৪-৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রস্তাবের ঘোষণা দেয়। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফর করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তখনই দুদেশ বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট অর্থাৎ বিগ-বি উদ্যোগের অধীনে অংশীদারিত্বের ধারণায় সম্মত হন। গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মহেশখালীর মাতারবাড়ি হতে যাচ্ছে দেশের আগামীর ‘পাওয়ার অ্যান্ড পোর্ট হাব।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্থও পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে আর কোনো বাধা নেই। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এখন ভূমি উন্নয়ন এবং বন্দরের ডিজাইন তৈরির কাজ করছে। এ কাজ শেষ হলে মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে। তবে এখনো এক অর্থে সমুদ্রবন্দরের কাজ চলছে। কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্পের অধীনে যে চ্যানেল ও ব্রেক-ওয়াটার নির্মিত হয়েছে সেটিও গভীর সমুদ্র বন্দরেরই অংশ হবে। সেই চ্যানেল সম্প্রসারণের মাধ্যমে তৈরি হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশার এই বন্দর।
কোল পাওয়ার জেনারেশন বাংলাদেশ লিমিটেডের বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের জন্য ২৫০ মিটার প্রস্থের ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল তৈরি করা হয়। আর এতেই দেখা দেয় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্ভাবনার উঁকি। এর আগে সোনাদিয়াতে এই বন্দর গড়ার চিন্তা ভাবনা ছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা জেটি নির্মাণের চ্যানেল হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, আর একটু গভীরতা এবং আরও কিছু দৈর্ঘ্য হলে তাতেই হয়ে যেতে পারে ডিপ সি পোর্ট।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার সহযোগিতায় সেখানে ১৪১৪ একর জমিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ওই কোল জেটির চ্যানেলের গভীরতা বৃদ্ধি ও প্রস্থ সম্প্রসারণের মাধ্যমে হয়ে যাবে গভীর সমুদ্রবন্দর। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে এই পোর্ট হবে এ অঞ্চলের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর। বাংলাদেশের অন্যান্য বন্দরকে সেবাদানের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশও তাদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এ বন্দরের সঙ্গে থাকবে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। জল, স্থল এবং রেলপথে সংযুক্ত থাকবে মাতারবাড়ি।