মাছের আঁশে দিন-বদলের স্বপ্ন!

মাছের আঁশ এখন আর আবর্জনা নয়। এই আঁশ দিয়েই নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন মাছকাটার পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকরা। মাছের আঁশ বিক্রি করে বাড়তি আয় দিয়ে নিজেদের সংসারে ফিরিয়ে আনছেন সুদিন তারা।

রপ্তানিখাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৭ হাজার ২৭৮ টন মাছের আঁশ উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৯০ ভাগই রপ্তানি হয়। মূলত জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও চীনে এসব আঁশ রপ্তানি হয়। প্রতি টন আঁশ ৩৫০-৪৭০ ডলারে বিক্রি হয়।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্বব্যাপী মাছের আঁশের নানা ব্যবহার রয়েছে। মাছের আঁশে থাকে কোলাজেন যা খাদ্য, ওষুধ, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কসমেটিকস শিল্পে ব্যবহার হয়। কোলাজেন নামক একটি পণ্য বিক্রি হয় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। চীন ও জাপানে এ আঁশ ব্যবহার করে বায়ো পাইজোইলেকট্রিক ন্যানো জেনারেটর তৈরি করা হয়, যেগুলো দ্বারা রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়া যায়।

ঘরোয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া মাছের আঁশ ব্যাটারি তৈরি, বৈদ্যুতিক পণ্য, কৃত্রিম কর্নিয়া, মাছ ও পোলট্রি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ বছরে ২০০ কোটি টাকার মাছের আঁশ রপ্তানি করে। এ পেশার সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ সরাসরি জড়িত। ১০-১২টি দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে।

মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, মাছের আঁশ সংগ্রহ করার পর সেই আঁশগুলো পরিষ্কার পানিতে অথবা গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। তারপর রোদে শুকানোর পর ঝরঝরে করা হয়। এরপরই বিক্রির উপযোগী হয়। বছরে দুই থেকে তিনবার এ আঁশ বিক্রি করা হয় পাইকারদের কাছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকার এসে মাছের আঁশগুলো কিনে নিয়ে যায়। প্রতি মণ আঁশ বিক্রি করা হয় ৩৬০০ থেকে ৪০০০ টাকা করে। শুধু আঁশ নয় মাছের নাড়িভুঁড়িও বিক্রি হয়। নাড়িভুঁড়ি ব্যবহার করা হয় মাছের খাদ্য হিসেবে।

রাজধানীর মাছ বাজারগুলোতে মাছ ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দা-বঁটি নিয়ে বসেন কিছু লোক। ক্রেতারা মাছ কেনামাত্র তারা সেগুলোর আঁশ ছাড়িয়ে চাহিদামতো কেটে দেন। বিনিময়ে নেন মাছের পরিমাণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক। মাছ কেটে তাদের বেশিরভাগের দৈনিক আয় এক থেকে ২ হাজার টাকা। অনেকের আয় আবার এর চেয়েও বেশি।

কারওয়ান বাজারের মো. মামুন। বয়স ৩০ এর কাছাকাছি। মাছ কাটার পেশায় যুক্ত আছেন ১২ বছর ধরে। তিনি জানান, কারওয়ান বাজারে এ পেশায় জড়িত রয়েছেন অনেকেই। পুঁজিবিহীন এ পেশায় শুধু বসার জায়গাটি ভাড়া নিতে হয়। আর প্রয়োজন হয় একটি বঁটির।

কারওয়ান বাজারে মাছ কাটছেন মো. মামুন। ছবি: সংগৃহীত

মাছ কাটার এ পেশায় নির্দিষ্ট কোনো কর্মঘণ্টা নেই উল্লেখ করে মামুন বলেন, সকাল থেকে বিকেল অবধি মাছ কাটার কাজ করি। এতে দৈনিক এক থেকে ২ হাজার টাকা আয় হয়। মাস শেষে যা প্রায় ৬০ হাজার টাকার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। আবার মাছের আঁশ বেচেও ভাল আয় হয়।

মাছ কাটার পারিশ্রমিক সম্পর্কে জানতে চাইলে মামুন বলেন, মাছের প্রকারভেদ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হয়। ছোট মাছ কাটতে কষ্ট বেশি হওয়ায় পারিশ্রমিকও বেশি নেয়া হয়। তাছাড়া নির্দিষ্ট কোনো পারিশ্রমিক নেই। ক্রেতার সঙ্গে দরদাম করে যেটি ঠিক হয়, সেটি নেওয়া হয়।

মামুনের মতো কারওয়ান বাজারে মাছ কাটার কাজ করেন আরও অনেকে। তারা বলেন, প্রতিদিন ভোরবেলা কাজ শুরু হয়। একা সব কাজ সামলে ওঠা সম্ভব হয় না। তাই অনেক সময় সাহায্য নিতে হয় অন্যদেরও। কেউ কেউ মাছ কেটে দৈনিক আয় করেন ৩ হাজার টাকার ওপরেও। তবে সেটি হাতে-গোনা দুই-একজন।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.