ভ্রাম্যমাণ আদালতে শিশুদের সাজা অবৈধ ঘোষণা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শিশুদের সাজা ও আটক রাখা অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। ৩১ পৃষ্ঠার এই রায়ে ১২১টি শিশুকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দেওয়া সাজা বাতিল করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শিশুকে সাজা দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি এবং শিশু আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই শিশুর বিরুদ্ধে যেকোনও অভিযোগের বিচার শুধু শিশু আদালতেই হতে হবে।
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদুল হাসান তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া এই রায় গতকাল বুধবার (২৪ জুন) সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) এই রায়ের তথ্য জানান মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম।
গত ১১ মার্চ প্রকাশ্য আদালতে এই রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। যার পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশিত হলো বুধবার। যদিও এরইমধ্যে হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে গত ১৬ মার্চ ওই রায় স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতির আদালত। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ নিয়মিত লিভ টু আপিল আবেদন দাখিল করবে।
হাইকোর্ট ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শ্যামলী ও ফার্মগেট এলাকায় সাজা দেওয়া ২৩টি শিশুর উদাহরণ তুলে ধরে বিস্ময় প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, মাত্র ৩২ মিনিটে দুটি ঘটনাস্থলে একই ভ্রাম্যমাণ আদালতে ২৩ শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ ও তাদের দণ্ড দেওয়াসহ বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা অসম্ভব। এটি করা একজন মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটি শুধুই বিবেক বর্জিত নয়, শিশুদের মৌলিক অধিকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল।
হাইকোর্ট বলেন, এধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকলে দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন উঠবে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে। তাই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শিশুদের বিচার করা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। হাইকোর্ট আরও বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত আমাদের স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থার সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি।
টঙ্গী ও যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি শিশুদের নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে গতবছর ৩১ অক্টোবর ‘আইনে মানা, তবুও ১২১ শিশুর দণ্ড’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওইসব শিশুদের বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম ও অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান।
প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ওইদিনই সুয়োমোটোভাবে আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে টঙ্গী ও যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দিদের মধ্যে যাদের বয়স ১২ বছরের নিচে তাদের অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দেন। আর যেসব শিশুর বয়স ১৩ বছর থেকে ১৮ বছর তাদের ছয় মাসের জামিনে মুক্তির নির্দেশ দেওয়া হয়।
জামিনপ্রাপ্তদের সংশ্লিষ্ট জেলা শিশু আদালতের সন্তুষ্ট সাপেক্ষে জামিননামা দাখিল করতে বলা হয়। ওই আদেশের পর ওই ১২১ শিশুর প্রায় সবাইকেই মুক্তি দেওয়া হয়।
হাইকোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করেন। রুলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শিশুদের দণ্ড দেওয়া ও আটক রাখা কেন অবৈধ হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র, আইন, জনপ্রশাসন, সমাজকল্যাণ এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, র্যাব মহাপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, টঙ্গী ও যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক, সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। এই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ১২১ শিশুকে দেওয়া দণ্ড এমনভাবে বাতিল হবে, যেন তাদের বিরুদ্ধে কখনও কোনও মামলা হয়নি, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি বা তাদের কোনও দণ্ড দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে এসব শিশুর জীবনে দণ্ডের কোনো প্রভাব পড়বে না। আইনের চোখে তারা নিষ্পাপ।
মাদকদ্রব্য আইনে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেওয়া সাজা বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায়ে বলা হয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার বিচার হবে সংশ্লিষ্ট বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারক হবেন অন্তত অতিরিক্ত জেলা জজ পদ মর্যাদার বিচারক। কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক হলেন নির্বাহী হাকিম বা মহানগর হাকিম। সুতরাং ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক কোনওভাবেই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এটি করলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর ৬ নম্বর ধারানুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এ কারণে এ আদালত এই বিধান গ্রহণ করছে না। এই ধারা যতদিন সংশোধন না হবে ততদিন পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদকদ্রব্য আইনের মামলার বিচার করতে পারে না। মাদকদ্রব্য আইনের অভিযোগ বিচার করার সুযোগ দেওয়া হলে তাদের ক্ষমতা আরও বেড়ে যাবে।