ভ্রমণ তুর্কিশ রিভেরা: ভূমধ্যসাগরের নীল উপকূলে এক স্বর্গরাজ্য
অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, রাজসিক আবহাওয়া ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে ঘেরা তুর্কিশ রিভেরা সারা বছর পর্যটকদের আহ্বান জানায়। ভূমধ্যসাগরের তীরে এই সুবিশাল উপকূল অঞ্চল লেবুর সুগন্ধে ভরা বাতাস, নীল জলরাশি ও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনে এক অনন্য অভিজ্ঞতা উপহার দেয়।
প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই উপকূলের এক পাশে উঁচু পাহাড়, অন্য পাশে ঝলমলে সমুদ্র। বছরের প্রায় পুরোটা সময় রোদ আর নরম আবহাওয়া এটিকে করে তুলেছে সারা বছরের ছুটির আদর্শ গন্তব্য। পরিবার, নবদম্পতি বা একাকী ভ্রমণপ্রেমী—সবাই এখানে খুঁজে পান নিজের মতো শান্তি। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, ঝকঝকে নীল উপসাগর ও কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বতমালা মিলিয়ে গড়ে উঠেছে ইতিহাস ও প্রকৃতির এক অসাধারণ মেলবন্ধন।
এ অঞ্চলের জীবনধারা গড়ে উঠেছে ভূমধ্যসাগরীয় ঐতিহ্যে। পর্যটকদের জন্য রয়েছে সমুদ্রতীরের সুস্বাদু খাবার, সঙ্গীত উৎসব, ইয়ট রেস, গলফ, সাঁতার ও সাইক্লিং প্রতিযোগিতা। নানা রকম জলক্রীড়া ও পাহাড়ি অভিযানের সুযোগও রয়েছে। বিলাসবহুল রিসোর্ট, ঐতিহ্যবাহী রান্না ও সংস্কৃতির মিশেলে তুর্কিশ রিভেরা যেন এক পরিপূর্ণ ছুটির দেশ।
বিলাসবহুল বিশ্রাম ও প্রকৃতির কোলে ছুটি:
তুর্কিশ রিভেরার উপকূলে সারি সারি সৈকত রিসোর্ট যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। সমুদ্রদৃশ্যমান রুম ও ভিলাসহ প্রতিটি রিসোর্টে রয়েছে সুইমিং পুল, ওয়াটারপার্ক, রেস্তোরাঁ, স্পা ও গলফ কোর্স। ফেথিয়ে থেকে মেরসিন পর্যন্ত উপকূলে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বুটিক হোটেল, পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ভিলা ও পুরোনো শহরের রাস্তায় গেস্টহাউস। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য রয়েছে বনভূমি, হ্রদপাড় বা সমুদ্রতীরে গ্ল্যাম্পিংয়ের সুযোগও।
ভূমধ্যসাগরের নরম আবহাওয়া আর স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে এটি ওয়েলনেস ট্রিপের জন্যও আদর্শ। স্থানীয় অলিভ অয়েল, মাছ ও সবজিভিত্তিক খাবার শরীর ও মনকে রাখে সতেজ। অধিকাংশ হোটেলে রয়েছে স্পা কমপ্লেক্স, যেখানে আধুনিক থেরাপির সঙ্গে মিলেছে ঐতিহ্যবাহী তুর্কিশ হামাম। প্রাচীন রোমকাল থেকে প্রচলিত এই স্নানপদ্ধতি শুধু বিশ্রাম নয়, আত্মশুদ্ধির এক অভিজ্ঞতা।

ইতিহাস ও প্রকৃতির মিলন:
ইরি খালের মতোই ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে তুর্কিশ রিভেরা এক খোলা জাদুঘর। অ্যান্টালিয়ার মধ্যে তিনটি প্রাচীন অঞ্চল—লিসিয়া, প্যামফিলিয়া ও পিসিডিয়া—একত্র হয়েছে। পাতারার ২০০০ বছরের পুরোনো থিয়েটার ও সংসদভবন আধুনিক গণতন্ত্রের পূর্বসূরি হিসেবে পরিচিত।
অ্যান্টালিয়া ঘিরে সবুজ বন ও সমুদ্রতীর ধরে নৌভ্রমণও দারুণ জনপ্রিয়। বেলদিবি, কেমের, টেকিরোভা, আদ্রাসান ও কাশের নীল উপসাগর নৌযাত্রার মূল আকর্ষণ। ফেথিয়ে থেকে অ্যান্টালিয়া পর্যন্ত ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ লিসিয়ান ট্রেইল ট্রেকিংপথের পাশাপাশি ইতিহাসের নিদর্শনে ভরা।
কেমের ও অলিম্পোসের পাইনবনে ট্রেকিং, গুহাভ্রমণ ও ক্যাম্পিং জনপ্রিয়। সাকলিকেন্টে বসন্তকালে একই দিনে স্কি ও সাঁতারের অনন্য অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। কাস ও কালেকয় অঞ্চলে স্বচ্ছ জলের সৈকত ও প্রাচীন সিমেনা নগরীর ডুবে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ কায়াক ভ্রমণে দেখা যায়।

সংস্কৃতি ও খাদ্যের স্বর্গ:
অ্যান্টালিয়া ও মেরসিন শহর দুটি প্রাণবন্ত নগরকেন্দ্র। এখানে হয় আন্তর্জাতিক অপেরা ও ব্যালে উৎসব, সাইড ও মেরসিন মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। শহরের গলি ও সমুদ্রতীরজুড়ে রয়েছে অসংখ্য ক্যাফে ও সীফুড রেস্তোরাঁ। টাটকা মাছ, হিবেশ, সী বিন, গ্রিল অক্টোপাস বা বাটারে বেক করা চিংড়ি—সবই এখানে জনপ্রিয়। শেষে অবশ্যই খেতে হয় কুমড়ার মিষ্টি তাহিনি ও আখরোট সহযোগে।
অ্যান্টালিয়ার সিশ কফতা ও পিয়াজ সালাদ, মেরসিনের বিখ্যাত তানতুনি র্যাপ, আর ফিনিকের কমলা ও আনামুরের কলা তুর্কিশ রিভেরার নিজস্ব স্বাদ।
ভূমধ্যসাগরের এই উপকূল ইতিহাস, প্রকৃতি, বিলাসিতা ও খাদ্যসংস্কৃতির মিলনস্থল—যে কারণে তুর্কিশ রিভেরা নিঃসন্দেহে তুরস্কের সবচেয়ে মোহনীয় পর্যটন গন্তব্য।
সূত্র: আলজাজিরা

Comments are closed.