ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না: বদরুদ্দীন উমর

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে হয়েছে- গত কয়েক বছর ধরে এমনটাই প্রচার করা হচ্ছে। বিশেষ করে পতিত সরকারের স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষার মাস এলেই বক্তৃতা-বিবৃতিতে জোরেশোরে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন বা খটকা থাকলেও সেই প্রশ্ন প্রকাশ্যে করার দুঃসাহস কারও হতো না। তবে প্রায় ১৬ বছর পর আবার ভাষা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস বলার সুযোগ সামনে এসেছে। দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক-গবেষক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর জানিয়েছেন, ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি তখন কারাগারে। এছাড়া দলগতভাবে আওয়ামী লীগেরও কোনো ভূমিকা ছিল না বলে জানান ভাষা আন্দোলনের এই প্রত্যক্ষদর্শী।

মহান ভাষা শহীদ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর এসব কথা বলেন।

ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ভূমিকা প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের কোনো ভূমিকা ছিল না। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা গলা ফাটিয়ে সব সময়েই বলে আসছেন, শেখ মুজিবই নাকি ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এমনকি এখানকার এক লেখিকা, উপন্যাসিক পত্রিকায় লিখল ‘বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন’। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কীভাবে এলো? চামচামার্কা লোকজন এসব বলে বেড়াচ্ছে। সম্পূর্ণ মিথ্যাকে তারা সত্য হিসেবে তুলে ধরছে। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি জেলে ছিলেন, ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। ফরিদপুর থেকে তিনি কীভাবে নেতৃত্ব দেবেন?’

বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘শেখ মুজিব নিজেও মিথ্যা কথা বলতেন। তিনি বলেছেন, তিনি নাকি ওয়াশরুমের জানালা দিয়ে চিরকুট লিখে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। একদম মিথ্যা কথা, একুশে ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ছিলেন না। গত বছরও হাসিনা বলেছে, ভাষা আন্দোলনের জন্য তার বাবা বারবার জেলে গেছে, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটা ঠিক শেখ মুজিব বারবার জেলে গেছেন, তিনি অনেক রকম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং সেসব কারণে জেলে গেছেন। কিন্তু মিথ্যা কখনো টিকে থাকে না। সত্য প্রকাশ পাবেই। সত্য প্রথমে উঁকি দেয়, আমি বলবো আমার লেখায় সত্য উঁকি দিয়েছে এবং এখন সত্য প্রকাশ্যে এসেছে। ইতিহাসকে কেউ ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারে না। কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে তারা চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে না।’

ভাষা আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকায় কারা ছিলেন-এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তমুদ্দুন মজলিস। এটিই সবচেয়ে সংগঠিত গ্রুপ ছিল। এর সকলেই ভাষা আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের সৈনিক পত্রিকা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। পরে ১৯৫২ সালের আন্দোলনে তাদের সে অবস্থা থাকেনি। এ সময়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এসেছিল। গ্রুপিং তৈরি হয়েছিল। এ সময়ে আন্দোলনে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, তবে বামপন্থী প্রভাবিত যুবলীগের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।’

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বদরুদ্দীন উমরের বয়স ছিল ২১ বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই আন্দোলনের তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের প্রত্যেকটি ঘটনায় আমি দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। আমি কোনো নেতা কিংবা কর্মীও ছিলাম না। আমি জীবনে কোনো ছাত্র সংগঠনে কাজ করিনি। ১৯৬৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম না। আমি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার সময় যে উপস্থিত থাকতাম, সেটা ব্যক্তিগতভাবে একজন অবলোকনকারী হিসেবে ছিলাম। এই থাকা আমার কাজে এসেছিল, যখন ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই লিখলাম। আমি চোখের সামনে দেখেছি কারা কী কাজ করছে। সেই আন্দোলনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না। সাধারণ ছাত্র হিসেবে বিভিন্ন ঘটনা দেখেছি। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ঘেরাওয়ের সময়, বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করার সময় এবং পরে মেডিকেল কলেজ সব জায়গায় উপস্থিত ছিলাম। মিছিলেও যোগ দিয়েছি।’

ভাষা আন্দোলনে তখনকার রাজনৈতিক দলের ভূমিকা কেমন ছিল-এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল না। আন্দোলনের কোনো পরিচালকও ছিল না। তবে ছাত্রদের যে আন্দোলন গড়ে উঠতে লাগলো এতে যুবলীগের যে ভূমিকা ছিল, সে তুলনায় আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে এটা বলা যাবে না এ আন্দোলন যুবলীগের নেতৃত্বে হয়েছে, তারা এই আন্দোলনের সাথে ছিল। তখন যুবলীগের সেক্রেটারি অলি আহাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে বিকৃতি ও মিথ্যাচারের অভিযোগ রয়েছে। জাতি হিসেবে এটি আত্মঘাতী। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? এ বিষয়ে দেশের বরেণ্য এই ইতিহাসবিদ বলেন, ‘শেখ মুজিবের শুধু ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা নিয়ে নয়, এ দেশের ইতিহাস যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে, আওয়ামী লীগই একটা অর্গানাইজেশন যারা প্রথম ‘ইতিহাস বিকৃতকরণ’ বলে একটা কথা চালু করেছে। এর আগে আমরা কখনো শুনিনি। তারাই এটা চালু করলো এবং তাদের চেয়ে বেশি ইতিহাসের বিকৃতকরণ আর কেউ করেনি। তারাই ইতিহাস চর্চাকে একদম শেষ করে ফেলেছে। কাজেই শুধু শেখ মুজিবের ভূমিকা নয়, এ দেশের রাজনীতির ইতিহাস সত্যনিষ্ঠ, নৈর্ব্যক্তিকভাবে রচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আশা করা যায় যে, নতুন প্রজন্ম সামনে সেই দায়িত্ব পালন করবে।’

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ- প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ সালে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু এই স্বাধীনতা হচ্ছে শুধু রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, দুনিয়ার মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ। কিন্তু জনগণের প্রাপ্তির দিক থেকে দেখা যাবে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রাপ্তি নেই। এমনকি বাংলাদেশ হওয়ার পর শেখ মুজিবের যে আওয়ামী শাসন তৈরি হলো, সাড়ে তিন বছরে জনগণ কিছুই পায়নি। শুধু শোষণ, নির্যাতন, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, নির্মমতা, দুর্ভিক্ষ এসব পেয়েছে। বলা যাবে না শেখ মুজিবের আমলে জনগণ কানাকড়িও পেয়েছে।

‘আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, শেখ মুজিবকে যখন ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হলো তখন তার জন্য রাস্তায় একটা মানুষও দাঁড়ায়নি। কেউ শোক প্রকাশ করেনি। উপরন্তু হাজার হাজার লোক রাস্তায় বেরিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিল। মিষ্টি বিতরণ করেছিল। অথচ এই শেখ মুজিবকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে এই দেশের জনগণ, লাখ লাখ মানুষ তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল। অনেক ভালোবেসে ছিল। সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে যখন হত্যা করা হলো, একটা লোকও রাস্তায় বেরিয়ে এলো না। কারণ কী? এটা তো ব্যাখ্যা করতে হবে, আওয়ামী লীগকে ব্যাখ্যা করতে হবে, শেখ মুজিবের বেটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে।’

বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘জনগণের এই যে প্রতিক্রিয়া, যেমন এখনো যা দেখা যাচ্ছে ৫ আগস্টে হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে চারদিক থেকে মানুষ রাস্তায় নেমে এলো, শেখ মুজিবের এবং তার গোষ্ঠীর ভাস্কর্য ও স্থাপনা ভেঙে দিল, কেন এমন হলো সেই প্রশ্নের জবাব তাদের খুঁজতে হবে। প্রশ্ন করার আগে ভালো-মন্দ খুঁজলে হবে না। এখানকার মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি প্রশ্ন করার আগে ভালো-মন্দ বিচার করতে নেমে যায়। এতদিন যারা ইতিহাস লিখেছে, তারা ফ্যাক্টচেকেও ভয় পায়, আসলে ফ্যাক্ট একটা বিষয়, যেখানে গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এখানে ঘটনা চাপা দেয়া হয়। মিথ্যাকে সামনে আনা হয়েছে।’

 

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.