“ব্যাংকিং ডিপ্লোমা শিক্ষার আধুনিকায়ন ও উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম তৈরির রূপরেখা”

মো. সাইফুল আলম তালুকদার

ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাঠে বিষয়বস্তুর পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে।মুখস্থ বিদ্যা কোনো কাজে আসে না। যদি ব্যাংকিং ডিপ্লোমা শেষ করার পর নতুন কোনো পণ্য, সেবা বা প্ল্যাটফর্ম চালু করতে না পারি, তাহলে এর প্রকৃত উপযোগিতা কী?

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা বছরে ১১ বিলিয়ন ডলার আয় করছে, যার মধ্যে মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার দেশে আসে। আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, এর মধ্যে মাত্র‌ ২ বিলিয়ন ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে। তাহলে আমাদের সব ব্যাংকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কি বাকি ৩ বিলিয়ন ডলার আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আনার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করা উচিত নয়?

বাংলাদেশ অন্ততপক্ষে আরো ১০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আনার জন্য জোরদার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে, যা ব্যাংকগুলোর জন্য একটি কম খরচে আমানত সংগ্রহের অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে। যদি এই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে, এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার হবে বলে আমি মনে করি।

শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, আমাদের কি কার্যকর এক/একাধিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত নয়?

ভারতে ইউপিআই (ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস) চালু করারট জন্য্ তাদের ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরবিআইকে অনুরোধ করেছিল। ইউপিআই হচ্ছে একটি মোবাইল-ভিত্তিক‌ পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, যা ব্যাংক থেকে মোবাইল ওয়ালেটে এবং মোবাইল ওয়ালেট থেকে ব্যাংকে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা স্থানান্তরের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক লেনদেনে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। পরে ভারতে এটি বাস্তবায়িত হবার পর ইউপিআই এখন বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলোর জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করছে।

আমরা কি এই ধরনের কাজ করার জন্য কি ব্যাংকারদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে কাজের কোনো উদ্যোগ নিতে পারি? আমরা শুধু ডিপ্লোমা পরীক্ষার জন্য তত্ত্ব মুখস্থ করার চেয়ে‌ এই ধরনের টেকসই এবং লাভজনক নতুন কিছু তৈরি করতে আগ্রহী হব কবে?

ব্যাংকিং খাতে নতুন প্ল্যাটফর্ম, পণ্য বা নীতি তৈরির জন্য বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ব্যাংকারদের গ্রুপভিত্তিক কাজ করা দরকার। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকারদের নিম্নলিখিত কিছু বিশেষায়িত গ্রুপে ভাগ করা যেতে পারে—

১) রেমিট্যান্স এবং আন্তঃসীমান্ত পেমেন্ট গ্রুপ: কিভাবে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যায়, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা যায়, সেই বিষয়ে তারা কাজ করবে।

২) ডিজিটাল ব্যাংকিং ও ফিনটেক গ্রুপ: ইউপিআইর মত প্ল্যাটফর্ম, ব্লকচেইন-ভিত্তিক সল্যুশন, স্মার্ট পেমেন্ট গেটওয়ে তৈরি করা নিয়ে গবেষণা করবে। উপরের দুইটি গ্রুপের জন্য ইউপিআই এবং আসিয়ান অঞ্চলের ‘নেক্সাস পেমেন্ট’ দুর্দান্ত উদাহরণ হতে পারে। ‌

৩) লো-কস্ট ডিপোজিট এবং ব্যাংকিং ইনোভেশন গ্রুপ: কম খরচে ব্যাংকের জন্য নতুন আমানত সংগ্রহের উপায় নিয়ে কাজ করবে, যাতে ব্যাংকগুলোর‌ হাই-কস্ট ফান্ডিং কমানো যায়।

৪) ব্যাংক পুনর্গঠন ও নীতি সংস্কার গ্রুপ: অপরিকল্পিত ঋণ বিতরণ, মন্দঋণ সমস্যার সমাধান, মন্দঋণ রিকভারি ও ব্যাংক পুনর্গঠনের জন্য পলিসি সাজাবে।

৫) এসএমই এবং ফাইন্যান্স ইনোভেশন গ্রুপ: প্রান্তিক উদ্যোক্তা, এসএমই ব্যবসা, খুচরা ঋণ ও ই-কমার্স খাতের জন্য নতুন ফিন্যান্সিং মডেল নিয়ে কাজ করবে। যাতে করে ব্যাংকিং সেবা দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে সহজে পৌঁছতে পারে।

৬) ব্যাংকিং এবং ক্যাপিটাল মার্কেট ইন্টিগ্রেশন ট্রাস্কফোর্স: বর্তমানে, ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের মধ্যে পর্যাপ্ত লিংকেজ নেই, যা মুনাফা, লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশে প্রচুর ব্যাংকের রয়েছে কিন্তু ভাল মানের বিনিয়োগ বা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার নেই।

কিভাবে এই সংগঠনগুলো বাস্তবে করা যায়

ক) ব্যাংকারদের স্বতন্ত্র সংগঠন বা ফোরাম গঠন করা যেতে পারে, যেখানে প্রত্যেকটি দল নির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণা করবে। এবং অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার এদের অর্থায়নে সাহায্য করার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত এবং বিশেষজ্ঞ সহায়তা প্রদান করবে।

খ) কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন থেকে একটি ইনোভেশন টাস্কফোর্স তৈরি করা যেতে পারে।

গ) ব্যাংকিং ডিপ্লোমাতে যেসব কোর্স পড়তে হয় সেগুলো তখন ম্যানুয়াল বা সহায়ক পাঠ্য পুস্তক হিসেবে কাজ করবে এবং বাস্তবসম্মত গবেষণা সম্পাদনে সাহায্য করবে। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে প্রত্যেক পরীক্ষার্থী/গ্রুপ নতুন কিছু উদ্ভাবনের সুযোগ পায়।

লেখক : মো. সাইফুল আলম তালুকদার
রিটেইল ব্যাংকার
বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসি

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.