বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে যত বেশি চ্যালেঞ্জ বাড়ছে, বাংলাদেশের মতো প্রাথমিক জ্বালানিনির্ভর দেশগুলোর জ্বালানি সার্বভৌমত্ব তথা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা তত হুমকির মুখে পড়ছে। জীবাশ্ম বা প্রাথমিক জ্বালানি আমদানিনির্ভর অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়লেও পরাশক্তিগুলোর নতুন ঠান্ডা ও প্রক্সি যুদ্ধ ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠছে। ক্লিন এনার্জিভিত্তিক জ্বালানির দিকে অধিক মনোযোগ না দেওয়ায় জ্বালানি রাজনীতির জটিলতায় পড়ে রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিনামূল্যে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সৌর, বায়ু ও সমুদ্র স্রোত ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকৃতিভিত্তিক টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অনেকটা শাপে বর হয়ে এসেছে। এ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিশ্বের বিদ্যুতের চাহিদার অর্ধেকই পূরণ করতে সক্ষম সৌরশক্তি।
২০২১ সালে রেকর্ড ২৯০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশ্বের উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হয়েছে। আইইএর গবেষণা মতে, বর্তমানে সৌর সেল চার-পাঁচ বছর আগের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশ বেশি কার্যকর। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সৌর প্যানেল ও বায়ু মিলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ যথাক্রমে ৮৫ ও ৫৫ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে মাত্র ৪ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস থেকে জোগান দিলেও এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হলেও, বৈশ্বিক দামের পতন ও অতিরিক্ত চাহিদার কারণে এ লক্ষ্যমাত্রা মিটিয়ে আরও বেশি পরিমাণে চাহিদার জোগান দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুতের চাহিদা যদি ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মেটাতে পারত তাহলে ৬০ বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করতে পারত।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার প্রায় ৯০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা ডিজেল বা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেটরের মাধ্যমে মেটানো হয়। প্রাথমিক জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতা কমাতে এবং একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমাতে এ খাতের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। যেমন চট্টগ্রাম ইপিজেডের ইউনিভার্সাল জিন্স লিমিটেডে ৩ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর প্যানেল বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে এবং আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ৩৩ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি কোরিয়ান ইপিজেডে বর্তমানে ২০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন উৎপাদিত সৌরবিদ্যুতের প্রায় ১০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামী বছরের মধ্যে আরও ২০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ মোট ৪০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ থেকে জোগান দেবে।
বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জোগানের কথা বলা হলেও অর্থায়ন বা বিনিয়োগের সন্তোষজনক পদক্ষেপে ঘাটতি রয়েছে। জমি সংকটের কথা বলা হলেও হাজার হাজার একর খাসজমি বেদখল হয়ে আছে। এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে মাত্র দুই থেকে তিন একর জায়গা লাগে। হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হলেও আগামী পাঁচ বছরে ৫ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ কেন পাওয়া যাচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় ২০টি জ্বালানি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র চারটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। ২০২১-২২ সালে জাতীয় বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫৭১ কোটি টাকা। অথচ শুধু ২০২১ সালেই জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিতে সরকার প্রায় ৭ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। বর্তমানে ফার্নেস ও ডিজেলভিত্তিক আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে পিডিবিকে প্রায় ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে অগ্রাধিকার দিলে এর প্রায় ৭৫ শতাংশ অর্থ বাঁচানো যেত। করপোরেট কর ও শুল্ক্ক ছাড়ের মতো প্রণোদনা না দিয়ে উল্টো বাজেটে সৌর প্যানেলের ওপর ১ শতাংশ কর বাড়ানো হয়েছে। অথচ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনামূল্যে ব্যবহূত সূর্যরশ্মি ও বায়ুর বাজারমূল্য যে কোনো বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা ও নির্ভরযোগ্য। শত শত বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষার ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই।
লেখকঃ জলবায়ু অর্থায়ন বিশ্নেষক. প্রধান নির্বাহী, চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ।