‘বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাশ বিদেশী শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অকৃতকার্য’
স্বাস্থ্য শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে না পারলে এই জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের আশু বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাশ করা বিদেশী শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে গিয়ে লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছেন- এমন তথ্যও বেরিয়ে আসে শনিবার (০৮ নভেম্বর) রাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ওয়েবিনারে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত সাপ্তাহিক এই অনুষ্ঠানে গতকালের আলোচনার মূল বিষয় ছিল- প্রি সার্ভিস মেডিক্যাল এডুকেশন।
ওয়েবিনারে আলোচক অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ খসরু, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শারমিন ইয়াসমিন। কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. জিয়া হায়দার।
শুরুতেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে আয়োজন করে যাবার জন্য ধন্যবাদ জানান আলোচকরা।
মেডিক্যাল কলেকে ভর্তি পরীক্ষায় ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ জরুরি উল্লেখ করে ডা. শারমিন বলেন, কম্পিটেন্সি বেইজড কারিকুলামের কথা বলা হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে চিকিৎসকদের মধ্যে যে অনেকক্ষেত্রেই যোগ্যতা এবং দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে তা করোনা মহামারীর সময়ে উন্মোচিত হয়েছে। ইনফেকশন প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল (আইপিসি), হেলথ এথিক, বিহেভিয়ারেল সায়েন্স এসব বিষয় নির্দিষ্ট বিভাগে সীমাবদ্ধ না রেখে সব কারিকুলামে যুক্ত করা উচিত। প্রত্যেক মেডিক্যাল কলেজে মেডিক্যাল এডুকেশন ইউনিট থাকলেও তাদের কাজগুলো- ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট, লার্নিং এনভায়রনমেন্ট, টিচিং এনভায়রনমেন্ট ঠিকঠাক তদারকি করা হয় না।
ডা. খসরু বলেন, খাতায়-কলমেই শুধু কম্পিটেন্সি বেইজড কারিকুলামের কথা বলা হয়। একসময় বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও এখিন সরকারিগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ দেখা যাচ্ছে না। সরকারি মেডিক্যালে রোগীদের বেশ প্রবাহ থাকলেও সেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষক পদায়ন করা যায়নি। কম্পিটেন্সি বেইজড করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক কমাতে হবে। এখন হচ্ছে লেকচার বেইজড। অন্যদিকে বেসরকারিগুলোতে শিক্ষক এবং রোগীর স্বল্পতা রয়েছে। অথচ কম্পিটেন্সি বেইজড এডুকেশনের মূল শর্তই হলো শিক্ষার্থীকে রোগীকে সম্মুখীন হতে হবে। অল্প সময়ে অনেক মেডিক্যাল কলেজ গড়ে উঠায় হয়তো ঠিকভাবে এসবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ভারত, পাকিস্তানে যথাক্রমে প্রতি ২৪ লক্ষ ও ১৮ লক্ষ মানুষের জন্য একটি মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও বাংলাদেশে প্রতি ১৪ লক্ষ মানুষের জন্য একটি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। মেডিক্যাল কলেকের আসনের ক্ষেত্রেও তাই। দেশে নামকাওয়াস্তে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বাড়ানো হলেও মানসম্পন্ন লোকবল তৈরি করা হয়নি৷ শিক্ষা হয়ে গেছে অনেকক্ষেত্রেই বইনির্ভর- মুখস্ত করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা। যার ফলে বর্তমান বিশ্বের সাথে আমরা তাল মিলাতে পারছি না।
বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা এবং আন্তরিকতার অভাব রয়েছে ডা. খসরুর এমন মন্তব্যে সমর্থন করে অধ্যাপক বেনজীর বলেন, কেবল ভালো চিকিৎসক কিংবা উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা হলেই জনস্বাস্থ্য ভালো হয়না, সেজন্য প্রয়োজন মানবিক এবং সার্বজনীন চিকিৎসাসেবা। গত ২০-২৫ বছরে দেশে চিকিৎসাব্যয় বাড়তে বাড়তে শুধু দরিদ্র নয় মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে। সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসাব্যয় বর্তমানে বোঝাস্বরূপ। অনেকে শুধু চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রেই শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে চিকিৎসকরা রোগীকে অত্যাধুনিক পরীক্ষা দিলেও রিপোর্ট ঠিকমতো দেখেন না। সবমিলিয়ে মানুষ দেশের চিকিসাসেবায় আস্থা হারিয়ে বিদেশ যেতে বাধ্য হচ্ছে।
তিনি বলেন, অনেকক্ষেত্রে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে গড়ে উঠার পেছনে ব্যবসায়িক মনোভাব এবং সরকারিগুলোর ক্ষেত্রে দুর্নীতি রয়েছে।
মেডিক্যাল এডুকেশনের একটা বড় সমস্যা সেখানে নিজস্ব লোকবল নেই উল্লেখ করে ডা. খসরু বলেন, একজন চিকিৎসক নিতে হলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। ১৩ টি হেলথ টেকনলোজি ইন্সটিটিউটের জন্য ভৌত অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ সবকিছু প্রস্তুত থাকলেও অধ্যক্ষসহ অন্যান্য লোকবল নিয়োগ করতে না পারায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়েছেন ডা. খসরুর এমন কথার প্রেক্ষিতে অধ্যাপক বেনজীর প্রশ্ন রাখেন, এসব খুটিনাটি বিষয়েও যদি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়, তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থাকার দরকার কি? তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, দেশে এমন কোন প্যারামেডিক্যাল ইন্সটিটিউট পাওয়া যাবে না যার অধ্যক্ষ পেশাদার কেউ। সেসব জায়গায় হয় প্রশাসনের লোক নয়তো মেডিক্যাল এডুকেশনের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়। মেডিক্যাল টেকনোলজিতে যারা ডিপ্লোমা করেন তাদের অবস্থা খুব খারাপ। সবমিলিয়ে সেবা দেয়ার জন্য যে টিম অর্থাত চিকিৎসক, নার্স, টেস্ট ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। এভাবে মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা প্রদান সম্ভব নয়।
দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়লেও মান বাড়ছে না উল্লেখ করে ডা. শারমিন বলেন, মানের ক্ষেত্রে কোন ছাড়া দেয়া উচিত নয়। অনেক বেসরকারি মেডিক্যাল কেন্দ্রিক সম্পূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্রিক কাজ করছে। কোন শিক্ষার্থীর ভালো পারফরম্যান্স না থাকা স্বত্ত্বেও পাশ করে চিকিৎসক হয়ে যাচ্ছে। টিচিং মেথোডোলজির প্রোগ্রামগুলো বছরজুড়ে প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজেই চালু করা উচিত।
ডা. খসরু এর সাথে যোগ করে বলেন, বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাশ করা ৭৩ শতাংশ চিকিৎসক ভারতে গিয়ে লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছেন। তাই বিএমডিসি বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের লাইস্যান্স দেয়ার আগে পরীক্ষা নেয়া উচিত যেনো তাদের মান নিশ্চিত হয়।
এর সাথে যোগ করে অধ্যাপক বেনজীর বলেন, নেপালি যেসব শিক্ষার্থী বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করে দেশে যাচ্ছে, তারাও সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না।