বাংলাদেশে দেড় হাজার কোটি টাকার পেয়ারার বাজার

পেয়ারা উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে এখন সপ্তম। ২০২০-২১ অর্থবছরে ফলটির উৎপাদন ছাড়িয়েছে ২৪ কোটি ৪০ লাখ কেজি। প্রতি কেজি পেয়ারার ভোক্তা ও পাইকারি বাজারের গড় দাম ৬২ টাকা বিবেচনায় নিলে এটির বাজার ছাড়িয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। তবে পেয়ারার ৩০ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে চট্টগ্রাম ও পিরোজপুরে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৬৭ হাজার ৩৪৫ একর জমিতে পেয়ারার উৎপাদন ছিল দুই লাখ ৪৩ হাজার ৯৫৭ টন। দেশে এই সময়ে পেয়ারার প্রায় ৩০ শতাংশই দুটি জেলায় উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৭ শতাংশ এবং পিরোজপুরে ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া বরিশালে প্রায় ৪ শতাংশ এবং যশোরে ৩ শতাংশ পেয়ারা উৎপাদিত হয়েছে। পেয়ারার প্রায় ৪৭ শতাংশই শুধু বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগেই উৎপাদিত হচ্ছে। পেয়ারা ঘিরে দেশের বৃহত্তম বাজার ও পর্যটন স্পট তৈরি হয়েছে কয়েকটি জেলায়। এর মধ্যে রয়েছে পিরোজপুর ও ঝালকাঠির ভাসমান হাট এবং চট্টগ্রামের পটিয়ার অর্গানিক হাট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক দশক ধরে দেশে কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশ হলেও এ শিল্পে পেয়ারা বরাবরই উপেক্ষিত। বর্তমানে আম থেকে জুস প্রক্রিয়াজাত করে সফলতা দেখাচ্ছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। অথচ পেয়ারা একটি পুষ্টিকর ও ঔষধি গুণসম্পন্ন ফল, যা দিয়ে জেলি, জ্যাম ও জুস তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু তার যথেষ্ট প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা না আসা এবং মেশিনারিজ কিনতে সরকারের সহায়তা না থাকায় এ শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না। অন্যদিকে অবকাঠামো দুর্বলতা, সংরক্ষণের অভাব ও বিভিন্ন সময় পোকার আক্রমণ পেয়ারার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করছে। এ ছাড়া বিপণন ব্যবস্থায় যেসব পদক্ষেপ দরকার তারও ঘাটতি রয়েছে। পেয়ারার বেশ কিছু শক্তিশালী দিক রয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু সহনশীল ফল হলো পেয়ারা। এ ছাড়া খরাসহিষ্ণুতা ও লবণাক্ততা সহ্যশক্তি রয়েছে এই ফলটির। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর জন্য অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হতে পারে পেয়ারা।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মেহেদী মাসুদ বলেন, দেশীয় ফলের মধ্যে কৃষককে সবচেয়ে বেশি মুনাফা দিচ্ছে পেয়ারা। দেশে ফলটি ঘিরেই উদ্যোক্তা কৃষক তৈরি হয়েছে। তাঁরা প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফলটি ঐতিহ্যগতভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। তবে পেয়ারার উৎপাদন সারা দেশে এরই মধ্যে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পেয়ারার বাজার দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সামনের দিনে আমরা পেয়ারা রপ্তানির প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা সারা দেশেই ফলটির সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিপণনে সহযোগিতা করা ছাড়াও রপ্তানিতে উৎসাহিত করছি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘বিবিএসের তুলনায় ডিএইর হিসাবে পেয়ারার উৎপাদিত তথ্যে বেশ ফারাক রয়েছে। বিবিএস মূলত পোস্ট হারভেস্টের ৩৫ শতাংশ ছাড়াও অন্যান্য ফসলোত্তর ক্ষতি বাদ দিয়ে হিসাব করে। প্রকৃতপক্ষে দেশে পেয়ারার উৎপাদন বিবিএসের হিসাবের দ্বিগুণ হবে। আমরা শিগগিরই পেয়ারার উৎপাদনে বিশ্বে ষষ্ঠ অবস্থানে চলে আসতে পারব। ’

বিবিএসের তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই লাখ ২৬ হাজার ২৮ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৮৮১ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই লাখ ৪১ হাজার ৫০৪ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দুই লাখ ২৯ লাখ ৩৭৬ টন। এ ছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই লাখ ১৪ হাজার ৩০৮ টন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দুই লাখ চার হাজার ৬২৫ টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দুই লাখ দুই হাজার ৫০৪ টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১২০ টন এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে এক লাখ ৯০ হাজার ৯৭ টন উৎপাদিত হয়। তবে দেশে পেয়ারার এই উন্নয়নে দুজন কৃষিবিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। তাঁদের একজন ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট কাজী এম বদরুদ্দোজা। তিনিই প্রথম দেশে উন্নত জাতের পেয়ারার উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করেন। তাঁর নামে দেশে কাজী পেয়ারার প্রচলন রয়েছে। মূলত দেশি পেয়ারা থেকে ১৯৮৫ সালে উচ্চ ফলনশীল কাজী পেয়ারার আবাদ শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) বারি-১ ও ২ এই জাত দুটি অবমুক্ত করে ১৯৯৬ সালে। মূলত এই তিনটি জাতের মাধ্যমেই দেশে পেয়ারার আবাদ বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছরে হাইব্রিড ও উন্নত বিভিন্ন জাত, বিশেষ করে বাউ জাতের পেয়ারা বাংলাদেশে উৎপাদন বাড়াতে আরো একধাপ সহায়তা করে। সেখানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এ রহিমের অবদান রয়েছে। এসব জাত ছাড়াও মুকন্দপুরী, আঙ্গুরী, ইপসা, সৈয়দী, এলাহাবাদ, এল-৪৯, চেরী, কাশি জাত রয়েছে।

চট্টগ্রামে বাড়ছে অর্গানিক পেয়ারা উৎপাদন : চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী অর্গানিক পেয়ারা (স্বাস্থ্যসম্মত) কাঞ্চন এখন বাজারে পুরোদমে আসতে শুরু করেছে। চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার পাহাড়ি এলাকার এ পেয়ারা এখন চট্টগ্রামজুড়ে চাষ করছেন বাগান মালিকরা। এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে নতুন পলি জমে। এতে এখানকার মাটি খুব উর্বর হয়। এ কারণে পেয়ারার চারা রোপণ থেকে শুরু করে গাছ বড় হওয়া এবং ফলন আসা ও পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত গাছের গোড়ায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও গাছে কীটনাশক ছিটানোর প্রয়োজন হয় না। এ জন্য এই পেয়ারাকে স্বাস্থ্যসম্মত বা অর্গানিক পেয়ারা বলা হয়। প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমের শুরুতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বাগিচাহাট, রওশন হাট, বাদামতল, কাঞ্চননগর গেট ঘর এবং দোহাজারী রেলওয়ে বাজার এলাকা ও পটিয়ার খরণা, কমল মুন্সির হাট ও কেলিশহর দারোগা হাটে এ পেয়ারার পাইকারি বাজার বসে।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে এ বাজারগুলোতে পাইকারি পেয়ারা বিক্রেতাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে লালসালু মোড়ানো পুঁটলির একেকটি ভার বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া পেয়ারা বহন করে বাজারে আনা, খুচরা ও পাইকারি বিক্রির সঙ্গে আট থেকে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় প্রতি মৌসুমে।

পেয়ারার ভাসমান হাট : সকাল হলেই মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে ঝালকাঠি শহরের কলেজ খেয়াঘাটে। ট্রলার নিয়ে বাসন্ডা খাল দিয়ে একের পর এক ছুটছে পর্যটকরা। নেচে-গেয়ে উৎসবে মাতোয়ারা অনেকেই। কেউ আবার প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের দৃশ্য ধরে রাখছে ক্যামেরায়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমজমাট বেচাকেনা চলছে দেশের বৃহত্তম পেয়ারার ভাসমান এই হাটে। ভ্রমণকারীদের জন্য পেয়ারাবাগানের মধ্যেই রয়েছে পার্ক। টিকিট কেটে যত খুশি পেয়ারা পেড়ে খাওয়া যাবে এখানে। পেয়ারাবাগান ও ভাসমান হাটের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে আনন্দ হৈ-হুল্লোড়ে সময় কাটিয়ে যায় পর্যটকরা। তবে সম্প্রতি চালু হওয়া পদ্মা সেতুর কারণে পেয়ারার উৎপাদন আরো বেগবান হবে এমনটাই আশা করছে স্থানীয় মানুষ।

এ বিষয়ে ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতুর প্রভাবে ঝালকাঠির কৃষকের উৎপাদিত পেয়ারা দেশের সব বাজারে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। কৃষকদের নগদ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। বাকিতে পাইকারের কাছে বিক্রি করতে হবে না। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পেয়ারা চাষিদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পেয়ারা চাষিদের সঙ্গে ভীমরুলি ভাসমান হাট বাঁচিয়ে রাখতে হলে এখানে একটি হিমাগার এবং জেলির কারখানা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া বিদেশে পেয়ারা রপ্তানির ব্যবস্থা করতে পারলে সুস্বাদু এ ফলের চাহিদা বেড়ে যাবে। বিদেশি কোনো কম্পানিও তখন এখান থেকে পেয়ারা নিতে আগ্রহী হবে। আমরা চাষিদের সব রকমের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। তাঁরা যেকোনো পরামর্শ চাইলে তা দ্রুত দেওয়া হয়। ’

দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখরিত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির পেয়ারাবাগান ও ভাসমান হাট। বাংলার আপেলখ্যাত স্বরূপকাঠি জাতের পেয়ারা। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলায় এ জাতের পেয়ারার বাণিজ্যিকভাবে আবাদ চলছে ৮০-৮৫ বছর আগে থেকে। পিরোজপুর উপজেলার কুড়িয়ানা, আটঘর, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, ধলহার, আতা, মাদ্রাসহ ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ১০টি খালে প্রতিদিনই পেয়ারার ভাসমান হাট বসে। দেখতে অনেকটা ইতালির ভ্যানিশ শহরের মতো, তাই তো এই এলাকাটিকে বাংলাদেশের ভ্যানিশ শহরও বলে থাকে কেউ কেউ।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.