বাংলাদেশে আইন প্রয়োগে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার আহ্বান এইচআরডব্লিউর

বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যেন তাদের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে আইনের শাসনের প্রতি সম্মান জানায়, তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

গত বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) এইচআরডব্লিউ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন- এইচআরডব্লিউর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও বিক্ষোভের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের আগস্টে আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিপীড়ক সরকার। ওই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ, বর্ডার গার্ড (বিজিবি), র‍্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িয়ে পড়েছিল।

এইচআরডব্লিউ বলেছে, নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা খাত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অবশ্য সরকার ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’– এর জন্য সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে মোতায়েন করেছে। এই অভিযানে ইতিমধ্যে প্রায় ২ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সমর্থক।

এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের নিপীড়নের পর বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তবে কর্তৃপক্ষগুলোকে অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করা উচিত হবে না। তার বদলে নিরপেক্ষতার সঙ্গে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে জুলাই–আগস্টে আন্দোলন দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গুলি, গণগ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। অনুমান করা হচ্ছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন।

এইচআরডব্লিউ বলেছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে একটি ‘হতাশাজনক চিত্র’ উঠে এসেছে, যেখানে ‘জাতীয়ভাবে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা থেকে সেরে ওঠার জন্য জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার জরুরি।’

এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ৭ ফেব্রুয়ারি সমর্থকদের উদ্দেশে ভারত থেকে বক্তৃতা দেওয়ার ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। ওই ঘোষণা ঘিরে সাম্প্রতিক সংঘাত শুরু হয়। যেসব শিক্ষার্থীসহ অন্যরা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন, তাঁরাই আবার বিক্ষোভ শুরু করেন। শেখ হাসিনার পরিবার ও দলের সদস্যদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। বিক্ষোভকারীরা তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িও গুঁড়িয়ে দেন, যাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল।

বিবৃতি অনুযায়ী, এর এক দিন বাদে ৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের পর অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয়, ‘পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট’ ব্যক্তিদের এই অভিযানের লক্ষ্যবস্তু করা হবে। ওই ব্যক্তিদের ‘ডেভিল’ বা ‘শয়তান’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

এইচআরডব্লিউ বলেছে, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও বিক্ষোভের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত একটি মৌলিক অধিকার। অন্তর্বর্তী সরকারকে এই অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। এমনকি সাবেক কর্তৃত্ববাদী সরকারের সমর্থকদেরও সমাবেশ ও বিক্ষোভের অধিকার রয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড অনুযায়ী, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও বিক্ষোভের অধিকারের সুরক্ষা প্রদান এবং এই অধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে সমাবেশ ও বিক্ষোভ ঘিরে বলপ্রয়োগের আগে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে যতটা সম্ভব অহিংস পথ অবলম্বন করতে হবে।

দেশে আইন–শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা অধ্যাপক ইউনূস সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছে এইচআরডব্লিউ। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামী মার্চে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি প্রস্তাব আনার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই প্রস্তাবে কারিগরি সহায়তা, আরও তদন্ত, তদারকি এবং জাতিসংঘ সমর্থিত মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।

মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের দমনপীড়নের কারণে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ এবং তাঁদের জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার পাওয়া উচিত। তবে তা হতে হবে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান রেখে।

‘মব’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) সহিংসতাসহ সব ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত উল্লেখ করে মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘কিন্তু কর্তৃপক্ষ যখন বিরোধীদের ‘ডেভিল’ হিসেবে চিত্রায়িত করে, তখন তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিপীড়নকে বাড়িয়ে দিতে পারে, যা কখনো জবাবদিহির আওতায় আসেনি।’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.