বরাদ্দের অভাব: থেমে যাচ্ছে ‘আলোর গাড়ি’

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আলো আমার আলো ওগো’ গানের সুর বাজিয়ে বই ভর্তি বাস দেখেই নানা বয়সী পড়ুয়ারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেন; নিতেন দুই মলাটের মাঝে পাতার ঘ্রাণ। কিন্তু ২৫ বছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিরএমন দৃশ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। অর্থ বরাদ্দের অভাবে বই ভরা এই ‘আলোর গাড়ি’র চাকা থামতে চলেছে ।

গত শতকের শেষ বছর ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি পরিচালনা করে আসছে। এ প্রকল্পের তৃতীয় পর্ব শেষ হচ্ছে চলতি বছরের শেষ দিন মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর)।

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রকল্প চালিয়ে নিতে সরকারের কাছ থেকে নতুন করে অর্থ বরাদ্দের খবর এখন পর্যন্ত মেলেনি। আর টাকার যোগান না পেলে লাইব্রেরির কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিপুল ব্যয়ভার চালিয়ে নেওয়ার ‘সঙ্গতি নেই’ বলে জানিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

তাই কার্যক্রমটি আপাতত ‘স্থগিত করার চিন্তা করছে’ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। এই খবরে মন খারাপ করেছেন বইপ্রেমী বহু মানুষ।

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি বন্ধের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বই পড়ুয়ারা।

ঢাকার বাংলা মোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামনেও লাইব্রেরি বন্ধ না করার দাবিতে বই পড়ুয়া এবং লাইব্রেরি সংশ্লিষ্টরা শনিবার অনশন করেছেন। তারা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্কারেরও দাবি তুলেছেন।

কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন বলেন, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কিছুসংখ্যক কর্মী দাবি করছেন যে, প্রকল্পের কর্মকাণ্ড একদিনও স্থগিত না রেখে এটিকে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের দায়িত্বে থাকা লাইব্রেরি কর্মকর্তা মো. আতিকুর রহমান বলেন, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি-গাড়ি ও অন্যান্য জিনিসপত্র ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে বুঝিয়ে দেওয়া এবং ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রমের যাবতীয় পাওনাদি বুঝে নিতে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নিয়মিত ও অনিয়মিত পাঠক প্রায় ৫ লাখ: ‘আলোকিত মানুষ চাই’ প্রতিপাদ্যে মানুষের হাতে বই পৌঁছে দিতে মাত্র কয়েকটি গাড়ি নিয়ে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির পথচলা শুরু করেছিল ২৫ বছর আগে।

বর্তমানে লাইব্রেরির গাড়ির সংখ্যা ৭৬টি। এই গাড়িগুলো দেশের ৩ হাজার ২০০টি এলাকায় বই দেওয়া-নেওয়া করে। যাকে ৩ হাজার ২০০টি ছোট লাইব্রেরিও বলা চলে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বলছে, এই লাইব্রেরির নিয়মিত ও অনিয়মিত পাঠক সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এককভাবে এই লাইব্রেরির যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছে।

এরপর ২০১৮ সাল থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই কর্মযজ্ঞে অর্থায়ন শুরু করে, ফলে এর পরিসরও বৃদ্ধি পায়।

২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির অনুমোদিত মেয়াদে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১১১ কোটি ১৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক শামীম আল মামুন বলেন, এই বিপুল সংখ্যক গাড়ি পরিচালনার ব্যয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই গাড়ি, বই, ইত্যাদি নিজস্ব হওয়া সত্ত্বেও জনবল ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে এই কার্যক্রমটি চালাতে হয়। গত ছয় বছর ধরে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কার্যক্রমটিকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে এসেছে।

এই কর্মকর্তা বলেছেন, মন্ত্রণালয় সহযোগিতা দেয় প্রতিপর্বে দুই বছরের জন্য। প্রথম পর্বটি শেষ হলে মন্ত্রণালয় আরও দুইবছর করে দুইবার এই সহযোগিতা দিয়েছে, যা ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরিচালক মামুন বলেছেন, প্রকল্পটি চালু রাখতে ‘চেষ্টা’ তারা করছেন। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি নতুন করে অর্থ বরাদ্দ পেতে। আমরা কর্মীদের এই কথাটি আগেই জানিয়ে দিয়েছি এবং এই মর্মে আশ্বস্ত করেছি যে, আমরা প্রকল্পটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ওই কর্মীরা এ ব্যাপারে অবিচল থেকে প্রথমে কেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং পরে অনশন কর্মসূচি শুরু করেছেন। আশা করি তারা বাস্তবতা অনুধাবন করবেন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বলছে, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয় প্রকল্প মেয়াদের ভিত্তিতে। তাই এর আগে প্রতি পর্বের মত ৩১ ডিসেম্বর তারিখে তাদের চাকরির মেয়াদও এবারের মত শেষ হয়ে যাবে।

নিয়ম অনুযায়ী এবারও তাদের সমস্ত প্রাপ্য (চার মাসের অতিরিক্ত বেতনসহ) অর্থ পরিপূর্ণভাবে পরিশোধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বরাদ্দ কী পাওয়া যাবে: সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এই প্রকল্পটিতে যুক্ত আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে।

প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না জানতে চাইলে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের প্রশাসন ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (উপসচিব) মোছা. মরিয়ম বেগম বলেন, প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো, বা নতুন অর্থ বরাদ্দ এখনো হয়নি। মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত জানতে পারলে সংশ্লিষ্টদের জানানো হবে।

তবে কী ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকার থেকে অর্থ বরাদ্দ না হলে প্রকল্পটি চলবে কি না, তা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বলতে পারবে। তারা এটি পরিচালনা করার সক্ষমতা রাখে কী না, তা তো আমরা বলতে পারব না। তারা যদি এটি পরিচালনা অব্যাহত রাখে, তবে চলবে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.