নতুন গতি পাচ্ছে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক
ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, ভিসা সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ
আগস্টে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক নতুন গতি পাচ্ছে। দ্রুত গলে যাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় দুই দেশের মাঝখানে জমে থাকা দীর্ঘদিনের বরফ।
বর্তমানে দুই দেশই ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, ভিসা সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
স্বৈরাচারী তকমা পাওয়া পলাতক হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ইস্যুতে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এছাড়া ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিভিন্ন ইস্যুতেও টানাপোড়েন চলে আসছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য হাসিনার প্রশাসনের ওপর দিল্লির তীব্র প্রভাবও ভূমিকা রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের সঙ্গে যোগাযোগ কোন পন্থায় হবে, সেটাও ভারত থেকেই ঠিক করে দেওয়া হতো বলে অভিযোগ আছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে চাইছে বাংলাদেশ। উভয় দেশই যেন ‘উইন উইন সিচ্যুয়েশনে’ থাকে সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে ঢাকা।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শেহবাজ শরীফৈ। ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শেহবাজ শরীফের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। সেখানে তারা দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে একমত হন। পরে ডিসেম্বর মাসে মিসরে ডি-৮ সম্মেলনে সাইড লাইনে ফের দুই সরকারপ্রধানের বৈঠক হয়। সেখানেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে আলোচনা হয়।
ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। ছবি: সংগৃহীত
সক্রিয় পাকিস্তানের হাইকমিশনার: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের আগে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হাইকমিশনারের তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না। জনরোষে হাসিনা পালিয়ে গেলে দেশের চিত্রপট পাল্টে যায়। তারপর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ বেশ সক্রিয় হন। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন তিনি। এছাড়া নিয়মিত নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বাড়ানোর বার্তা দিচ্ছেন তিনি।
ভিসা ফি মওকুফ: ফ্যাসিস্ট হাসিনার সরকার উৎখাতের পর গত ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সরকার ১২৬টি দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা ফি মওকুফ করে। এই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। যে কারণে বাংলাদেশিরা ভিসা ফি ছাড়াই পাকিস্তানে যেতে পারছেন। এছাড়া ই-ভিসা সুবিধাও পাচ্ছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা।
ঢাকা-করাচি সরাসরি ফ্লাইট: ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৭ বছর বন্ধ থাকার পর বর্তমানে দুই দেশের মধ্যকার সরাসরি ফ্লাইট শুরুর বন্দোবস্ত হচ্ছে। ঢাকা-করাচি রুটে ‘ফ্লাই জিন্নাহ’ নামে একটি এয়ারলাইন্সকে ফ্লাইট চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এই রুটে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের কাউন্সিলর (প্রেস) মো. ফসিহ উল্লাহ খান বলেন, দুই দেশের মধ্যে ফ্লাইট চালুর লক্ষ্যে কাজ চলছে। আমরা আশা করি ২০২৫ সালের মধ্যেই এসব ফ্লাইট চালু হবে।
করাচি-চট্টগ্রাম জাহাজ চলাচল শুরু: দীর্ঘ দিন ধরে চট্টগ্রাম-করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। এর আগে পাকিস্তানের কোনো পণ্য বাংলাদেশে আনতে হলে তৃতীয় কোনো দেশ হয়ে আনতে হতো। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে করাচি থেকে দুটি জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে। ফলে আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী: আগামী এপ্রিল মাসে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। এ সফর সফল করতে উভয়পক্ষই এখন কাজ করছে। ইসহাক দারের সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাকিস্তান সম্পর্কে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য: ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ৫৩ বছরের অমীমাংসিত বিষয় আছে। তবে, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আমরা যদি ওই ইস্যুগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে আমাদের কোনো লাভ নেই। ওদেরও কোনো লাভ নেই। আমরা অবশ্যই আমাদের স্বার্থ রক্ষা ও উদ্ধারের চেষ্টা করবো। পাশাপাশি আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে আরেকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক হিসেবেই দেখতে চাই।
পাকিস্তানের হাইকমিশনার যা বলছেন: ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ বলেছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও সহযোগিতার জোরদার প্রয়োজন।
তিনি আশা করেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একসঙ্গে কাজ করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করবে।