টাঙ্গাইল সদর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল মগড়া ইউনিয়নের চৌরাকররা গ্রাম। এক সময় এই গ্রামে ছিল না উচ্চশিক্ষিত মানুষ।পড়াশোনার জন্য ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ছিল না আশেপাশের গ্রামে। ফলে উচ্চশিক্ষার জন্য ১২ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে আসতে হতো ওই গ্রামের শিক্ষার্থীদের। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, ওই এলাকায় ছিল না কোনো পাঠাগারও।
এদিকে মানব সভ্যতার ইতিহাস আলোকিত করার শ্রেষ্ঠ অংশ বা সম্পদ হলো পাঠাগার। আর পাঠাগার হলো বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ও অন্য তথ্যসামগ্রীর একটি সংগ্রহশালা, যেখানে পাঠক গ্রন্থপাঠ, গবেষণা ও তথ্য অনুসন্ধান করতে পারেন। সমাজের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়ানো, তথা সুশিক্ষার কথা বিবেচনা করে, ‘এসো বই পাড়ি, নিজেকে আলোকিত করি’ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ওই গ্রামে এক পুলিশ সদস্যের উদ্যোগে পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাতিঘর আদর্শ পাঠাগার’। পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা মো. কামরুজ্জামান বাংলাদেশ পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
পাঠাগারটিতে বই পড়া, জ্ঞান আহরণ তথা নতুন তথ্য অনুসন্ধানের জন্য প্রতিনিয়তই পাঠকদের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কোনো বয়সের নারী-পুরুষ এখানে এসে জ্ঞানের অতল সমুদ্রে অবগাহন করতে পারেন। আবার কেউ চাইলে নির্দিষ্ট নিয়মের মাধ্যমে পাঠাগারের সদস্য হতে পারেন। কোনো পাঠক ইচ্ছা করলে পাঠাগারে বসে বই পড়তে পারেন, আবার চাইলে বাড়িতে নিয়েও পড়তে পারেন।
জানা যায়, পাঠাগারটি পরিচালিত হচ্ছে স্থানীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে। তাদের সহযোগিতায় সদস্য হওয়া, বই নেওয়া, বই ফেরৎ দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পন্ন হয়ে থাকে। তারাও তাদের কর্তব্য সুন্দরভাবে পালন করছেন। যদিও এটি পারিবারিক পাঠাগার, তবুও গ্রন্থাগারটি পরিদর্শন করলে বোঝা যায়, এর গভীরের সৌন্দর্য। পাঠাগারের যাবতীয় কার্যক্রম সত্যিই অবাক হওয়ার মতো।
মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘অনেক মানুষ আছেন, যারা বই পড়তে ভালোবাসেন। তবে নিয়মিত বই কিনে পড়ার সামর্থ নেই, তাদের জন্য সহজে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। পাঠাগারটি শুধু বই পড়াকে ঘিরে নয়, আমরা বিনোদনের আয়োজনও করে থাকি। প্রতি বছর প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতা, বৃত্তি দেওয়া, কবিতা আবৃত্তি, গান এবং কোরআনের হাফেজদের নিয়ে আল-কোরআন পাঠসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে করণীয় নির্ধারণে আলোচনা সভাও করে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাঠাগারের সংগ্রহে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সহস্রাধিক বই রয়েছে। ধর্মীয়, সাহিত্য, বিজ্ঞানমনস্ক, ইতিহাসমূলক, জীবনী, চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বই, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, মাসিক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, শিশু সাহিত্য ছাড়াও একাডেমিক বই বিদ্যমান। পাঠাগারটির উন্নয়নে যারা বই দিয়ে এবং বিভিন্ন সময় সুপরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, তাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।’
পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আশেপাশে কোনো পাঠাগার না থাকায় বই পড়তে হলে আমাদের ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জেলা সরাকারি গ্রন্থাগারে যেতে হতো। যা অনেক কষ্টসাধ্য ও দুরূহ ছিল। তাই ইচ্ছা থাকলেও সবসময় সুযোগ পেতাম না। এই পাঠাগার প্রাতিষ্ঠার ফলে আমরা খুব সহজে বই পড়ার সুযোগ পেয়ে অনেক উপকৃত হচ্ছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আজেবাজে আড্ডা না দিয়ে এই পাঠাগারে সময় দিচ্ছে, যা তাদের বিভন্ন আসক্তি থেকে দূর রাখছে। তাই আশা করি, এভাবেই এগিয়ে যাবে বাতিঘর আদর্শ পাঠাগার, চারদিকে ছড়াবে জ্ঞানের আলো।’
চৌধুরীমালঞ্চ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাঠাগারটি সাধারণ মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করছেন, যা তাদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
মগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘এরকম একটি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পাঠাগারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ জানাই। জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠনে এই পাঠাগারটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আমি প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নে সবসময় পাশে থাকবো।’
পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভবিষ্যতে পাঠাগারের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ভবন নির্মাণসহ বইয়ের সংগ্রহ আরও বেশি সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে। মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি সমাজের বিবিধ সমস্যাগুলো সমাধানেও এই প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। তাই আশা করি, আমাদের সহযোগিতায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তি, সংগঠন যদি এগিয়ে আসে, তাহলে মাদকাসক্তি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা বিলুপ্তকরণসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে।’