ফের ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করছে বিতাড়িত রাজনৈতিক পরিবারটি

উচ্ছ্বসিত যুবকেরা একটি পুলের মধ্যে আনন্দে মেতেছে, কেউ কেউ গায়ে সাবান মেখে উল্লাস করছে। সুসজ্জিত হলের ভেতরে মানুষ নাচছে, কেউ ব্যান্ড বাজাচ্ছে, কেউ ভেঁপুর সুরে সুরে তালে নাচছে।

২০২২ সালের ১৩ জুলাইয়ের এই দৃশ্যগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, যখন শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করেছিল এবং রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

এটি ছিল শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের বিজয়ের এক অসাধারণ মুহূর্ত। খবর বিবিসির।

আন্দোলনের সময়, শ্রীলঙ্কার লাখ লাখ মানুষ কারফিউ অমান্য করে মিছিল নিয়ে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, টিয়ার গ্যাস ও জলকামানের বাধা উপেক্ষা করে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শ্রীলঙ্কার জনসাধারণ সরকারের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছিল।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে রনিল বিক্রমাসিংহে তার দলের একমাত্র এমপি ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে রনিল বিক্রমাসিংহে তার দলের একমাত্র এমপি ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত।
গোতাবায়া রাজাপক্ষে আন্দোলনকারীদের পদত্যাগের আহ্বান উপেক্ষা করে অনেক দিন পার করেন। তার ভাই, মাহিন্দা রাজাপক্ষে, যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, জনরোষ সামলাতে আগেই পদত্যাগ করেছিলেন। তবে রাজাপক্ষে পদত্যাগে সম্মত না হওয়ায় আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

শ্রীলঙ্কায় কয়েক মাস ধরে চলা এই বিক্ষোভকে স্থানীয় সিংহলী ভাষায় ‘আরাগালয়’ বলা হয়, যার অর্থ ‘সংগ্রাম’। জুলাই মাসে এই আন্দোলন তার চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছায়, যখন প্রবল আন্দোলনের মুখে গোতাবায়া রাজাপক্ষের দ্রুত এবং লজ্জাজনকভাবে পতন ঘটে।

তবে, কিছু মাস আগেও এমন কিছু ঘটবে, তা ছিল একেবারে অকল্পনীয়।

দীর্ঘদিন ধরে রাজাপক্ষে পরিবার, মাহিন্দা রাজাপক্ষের নেতৃত্বে, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে কর্তৃত্ব করে আসছিল।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে তার প্রথম মেয়াদে তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সমাপ্তির নেতৃত্ব দেন। এই বিজয়ের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী জনগণ তাকে জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখতে শুরু করে।

কিন্তু পরবর্তীতে রাজাপক্ষে পরিবার আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। মাহিন্দা তার ছোট ভাই গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষা সচিবের পদে নিয়োগ দেন, যিনি ওই পদে থেকে কঠোর ও বিতর্কিত অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আরেক ভাই বাসিল ছিলেন অর্থমন্ত্রী এবং চামাল ছিলেন সংসদের স্পিকার।

রাজাপক্ষে পরিবার, যাদের এক সময় দেশটির রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হতো, এখন ক্ষমতায় ফেরার নতুন কৌশল নিয়ে আবার সক্রিয় হতে শুরু করেছে।

বিতাড়িত এই পরিবার আবারও ক্ষমতায় ফেরার পরিকল্পনা করছে। বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এই পরিবার দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভিন্নমত দমনসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে। তবে তার আগে সরকারের কিছু নীতির কারণে দেশটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সতেরো বছর পর, শ্রীলঙ্কার জনগণ রাজাপক্ষে পরিবারের পতন উদযাপন করে। তাদের বিশ্বাস ছিল, একজনের পতন মানেই পুরো পরিবারের ক্ষমতা থেকে বিদায়।

কিন্তু সত্যিই কি তা হয়েছে?

দুই বছর পর, মাহিন্দা রাজাপক্ষের ছেলে নামাল রাজাপক্ষে ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লক্ষণ সান্দারুয়ান বিবিসি সিনহালাকে জানান, ‘গণবিক্ষোভের পর যারা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়েছিল, তাদের আবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা খুবই হতাশাজনক। ভোটারদের কেউ কেউ আবারও সেই পরিবারের সদস্যকে ভোট দিতে পারেন।’

নামালই শুধু নন, যারা রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরে এসেছেন। গোতাবায়া রাজাপক্ষে, যিনি বিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়েছিলেন, খুব বেশিদিন বাইরে ছিলেন না। ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র ৫০ দিন পর, তিনি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড হয়ে দেশে ফেরেন এবং ফিরে এসে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সব সুবিধা পান। তাকে দেওয়া হয় একটি বিলাসবহুল বাংলো এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যার ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করে।

রাজাপক্ষে বাকি মেয়াদে বিরোধী রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ক্ষমতা গ্রহণের আগে তিনি ছয়বারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি রাজাপক্ষে পরিবারকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। বলা হয়, তিনি পরিবারটিকে পুনর্গঠনের সুযোগ দিয়েছেন এবং তাদের বিচার থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও বিক্রমাসিংহে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই, কলম্বোর গল ফেস এলাকায় বিক্ষোভ দমাতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জয়দেব উয়াঙ্গোদা বলেন, ‘রনিল বিক্রমাসিংহে রাজাপক্ষে পরিবারকে জনগণের তীব্র ক্ষোভ থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি এসএলপিপি-নেতৃত্বাধীন সংসদ ও সরকারের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছেন এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে কিছুই করেননি। এমনকি রাজাপক্ষে পরিবারের বিরুদ্ধে কোনও তদন্তেও অগ্রগতি হয়নি।’

বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুৎ ঘাটতি নেই, তবে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সরকার বিদ্যুৎ ভর্তুকি বাতিল করেছে এবং কল্যাণমূলক খরচ কমিয়েছে। পাশাপাশি করের হারও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাজাপক্ষে পরিবারের পতনের আগে দেশটি কয়েক মাস ধরে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, খাদ্য ও ঔষধ সংকটে ভুগছিল। কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে কঠোর কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল, যা না নেওয়ায় বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্ট ২০২৩ সালে রায় দেয় যে গোতাবায়া এবং মাহিন্দাসহ রাজাপক্ষে পরিবার ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সরাসরি দায়ী।
রাজাপাক্ষেদের পতনের পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে জোর করে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা। ছবি: সংগৃহীত।

নামাল রাজাপক্ষে নিজেকে পরিবর্তনের দূত হিসেবে উপস্থাপন করলেও, অনেকে তার প্রার্থিতাকে বিতর্কিত পরিবারটির ক্ষমতায় ফেরার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তার প্রচারণা মূলত তার বাবা মাহিন্দা রাজাপক্ষে উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যাকে এখনও অনেক শ্রীলঙ্কান নায়ক মনে করেন।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে বিরুদ্ধে জাতিসংঘ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলেছিল। জাতিসংঘের মতে, গৃহযুদ্ধ চলাকালে ৪০ হাজার তামিল বেসামরিক ব্যক্তিসহ এক লাখেরও বেশি মানুষ শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল। তবে মাহিন্দা এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছেন।

নামাল রাজাপক্ষের নির্বাচনী প্রচারণায় তার বাবা মাহিন্দা রাজাপক্ষের ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোটবেলার নামালের বাবার সাথে থাকা ছবিগুলোও শেয়ার করছেন কেউ কেউ।

রাজাপক্ষে পরিবারের পতনের পর হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে ঢুকে পড়ে। নামাল নিজেকে তার বাবার মতো করে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, এমনকি তার বাবার মতো গোঁফ রেখেছেন এবং মাহিন্দার পরিচিত লাল শালও পরেছেন।

নামালের নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টগুলোতে বলা হচ্ছে, ‘আমরা কোনও চ্যালেঞ্জকে ভয় পাই না, সবার মতামতকে স্বাগত জানাই। আমি এটা আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি।’

অন্য একটি পোস্টে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে ‘দেশপ্রেমিক, সাহসী এবং দূরদর্শী’ বলা হয়েছে।

তবে নামালের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে এক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, ‘রাজাপক্ষে পরিবারের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী কেন রাষ্ট্রপতি পদে ভোট করছে, এটি কি পারিবারিক ব্যবসা নয়?’

মাঠ পর্যায়ের প্রতিক্রিয়াগুলো আরও তীব্র।

গ্রামবাসী এইচএম সেপালিকা বিবিসি সিংহলাকে বলেন, ‘আমি কখনও নামাল রাজপক্ষেকে ভোট দেব না। আমরা যে কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছি, তার জন্য রাজপক্ষে পরিবারই দায়ী।’

হাম্বানটোটার একজন দোকান সহকারী নিশান্তি হারাপিটিয়া বলেন, ‘এ দেশের মানুষ এক হয়ে রাজপক্ষেদের বিদায় করেছিল। কিন্তু তারা এখনও এতটাই ক্ষমতালোভী যে, ফিরে আসার চেষ্টা করছে এবং জনগণকে তাদের জন্য ভোট দিতে বলছে।’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.