‘ফজিলাতুন্নেসা মুজিব চা-বিস্কুট খাওয়ালেন’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ। তার আরেকটি বড় পরিচয়- তিনি সদ্যপ্রয়াত লেখক, সাংবাদিক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশবিদ মাহফুজ উল্লাহর আপন বড় ভাই। তিনি উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত মুজাফফর আহমেদের দৌহিত্র। এক সময় তুখোড় রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশে-বিদেশে ছিলেন সুপরিচিত। মাহবুব উল্লাহর অনুসারী ছিলেন আজকের অনেক প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ এবং গুণী ব্যক্তিত্ব। একান্ত আলাপচারিতায় যেমন করেছেন সদ্যপ্রয়াত অনুজের স্মৃতিচারণ, তেমনি উঠে এসেছে বিবিধ প্রসঙ্গ।
আপনারা কয় ভাইবোন?
আমরা দুই ভাই, দুই বোন। আমার বাবা বিয়ে করেন ১৯৩৯ সালে। আমার জন্ম হয় ১৯৪৫ সালে। আমার আগে আমার এক বোনের জন্ম হয়েছিল, কিন্তু সে ছিল মৃত। যাই হোক, আমার পরে এক বোন। তারপর মাহফুজ উল্লাহ। তারপর এক বোন।
ছোটভাইকে (মাহফুজ উল্লাহ) নিয়ে ছোটবেলার কোনো মজার স্মৃতি মনে পড়ে?
ছোটবেলায় বাবা আমাকে কঠোর শাসন করতেন। কেন যেন মনে হতো, বাবা ওকে বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন। (মৃদু হেসে) হয়তো বিষয়টি তেমন ছিল না। কিন্তু আমার তখন কেন যেন এমনটাই মনে হতো।
মাহফুজ উল্লাহর জানাজা এবং শোকসভায় অনেকদিন পর বহু মত, বহু পথের মানুষকে এক মঞ্চে দেখা গেছে। নানা কারণে নানান মানুষ তাকে পছন্দ করতো। আপনার দৃষ্টিতে তার সবচেয়ে বড় গুণ কি ছিল?
ঠিক এটাই। মাহফুজ উল্লাহ সব ধরনের, সব মতবাদের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারতো। কারো প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করতো না।
বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানীকে নিয়ে যে বই লেখার কথা ছিল, সেটি কতদূর এগিয়েছিল?
সেটা ও শুরু করে যেতে পারেননি। যদিও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ফেলেছিল।
ভারতে থাকাকালীন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মাহফুজ উল্লাহ…
হ্যাঁ, তখন সে ‘বিচিত্রা’তে ছিল। ওই সময়ে ওর নিজ হাতে তোলা একটি ছবিই পরবর্তীতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পোস্টারে ব্যবহৃত হয়।
হাসপাতালে ভর্তির আগে তিনি আপনাকে শেখ হাসিনার একটি ছবি দেখিয়েছিলেন। এর কারণ কি বলে মনে করেন?
হ্যাঁ, সেটা হাসপাতালে ভর্তির বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। জানিনা কি মনে করে দেখিয়েছিল। তবে ছবিটা শেখ হাসিনার অপেক্ষাকৃত কম বয়সের। তার চোখের চাহনি ছিল অন্যরকম। তবে এ নিয়ে তেমন কথা হয়নি।
কিছুদিন আগে মাহফুজ উল্লাহ স্মরণে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে আমি প্রথম যাকে খুঁজেছি তিনি হলেন মাহবুব উল্লাহ। শুনেছি ১৬ই ডিসেম্বরের পর পর বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে দেখা হলে তিনিও একই কথা বলেছিলেন…
হ্যাঁ। আমি, মাহফুজ উল্লাহ এবং আমার স্ত্রী বিজয়ের দু-তিন দিন পর সেসময় ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে দেখে বললেন, আমিতো ভেবেছিলাম তোমাকে ওরা মেরেই ফেলেছে। তিনি আমাদের ‘কনডেন্সড মিল্ক’-এ তৈরি দুধ-চা খাওয়ালেন। সঙ্গে ছিল বিস্কুট, নাম বাবুল, স্পষ্ট মনে আছে। সেখানে শেখ হাসিনাও ছিলেন, তার কোলে ছিল শিশুসন্তান জয়।
উপমহাদেশে বাম রাজনীতির পুরোধা কমরেড মুজাফফর আহমেদের আপনারা দৌহিত্র। উনার সঙ্গে আপনাদের দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশে আসলে প্রথম আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়। এর আগে অবশ্য পত্র মারফত যোগাযোগ ছিল। উনি আমাদের নানা হন। নানারা তিন ভাই ছিলেন। আমার নানা মাওলানা মকবুল আহমেদ ছিলেন সবার বড়। তারপর খুরশিদ আহমদ এবং সবার ছোট ছিলেন মুজাফফর আহমেদ।
আপনার ভাই মেধাবী ছিলেন এবং মেট্রিকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছিলেন বলে পত্রিকায় লিখেছেন। আপনার নিজেরও তো সেরকম অর্জন রয়েছে বলে শুনেছি…
মেট্রিকে আমি সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পাইনি। তবে ‘ইন্টারমিডিয়েট’-এ দ্বিতীয় হয়েছিলাম, ঢাকা কলেজে ‘আর্টস’ থেকে পরীক্ষা দিয়ে।
বাংলাদেশের অনেক গুণী এবং বিখ্যাত লোক আপনার অনুসারী ছিলেন। তেমন কিছু নাম যদি বলতেন…
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, সাবেক মন্ত্রী ও জাপা নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, অপরাজেয় বাংলা স্থাপনার ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, জাবির দুই উপাচার্য খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান ও ড. জসিম উদ্দিন আহমদ, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমেদ কামাল, ৭১-এর শহীদ সৈয়দ রুহুল আমীন, সিরাজ শিকদার…আপাতত এসব নামই মনে পড়ছে।
আপনার ছোটভাইকে নিয়ে লেখা শোকগাথার দুটি লাইন ছিল এমন- ‘আমরা ছিলাম দুটি ভাই, মানিকজোড় যেন। এমন স্নেহ, এমন ভালোবাসা… যাপিতজীবনে কথা বলিনি, বিষয় ছিল না হেন।’ বাস্তবেও কি তাই ছিল?
হ্যাঁ। ঠিক তাই।