প্রাথমিক-মাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে বড় পরিবর্তন

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। এর মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত কিছু বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সূত্র মতে, পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কিত বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবই থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত ছয়টি গদ্য ও প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হবে এবং জুলাই আন্দোলনের ওপর চারটি লেখা যুক্ত হয়েছে।

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত তিনটি গদ্য ও কবিতা বাদ দেওয়া হতে পারে এবং জুলাই আন্দোলনের চারটি লেখা যুক্ত হয়েছে।

ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই থেকে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও তিতুমীর সম্পর্কিত একটি করে বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া, সেলিনা হোসেনের পাঁচটি, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের দুটি, সৈয়দ শামসুল হকের একটি, রোকনুজ্জামান খানের একটি, নির্মলেন্দু গুণের একটি এবং সাবেক আমলা কামাল চৌধুরীর একটি লেখা পাঠ্যবই থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত অতিরঞ্জিত বিষয়বস্তু পাঠ্যবই থেকে সরানো হচ্ছে। এক নেতা, এক দেশ—বিষয়টি এমন নয়। এখানে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, জিয়াউর রহমানসহ অন্যান্য নেতারাও ছিলেন। তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।’

তিনি জানান, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণসহ শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত বেশকিছু বিষয়বস্তু এখনো অনেক পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মাওলানা ভাসানী সম্পর্কিত বিষয়বস্তু সরানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটি পাঠ্যবই থেকে সরানো হতে পারে, তবে অন্য একটি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’

সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ওপর একটি লেখা সরানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তার ওপর একটি লেখা অন্য একটি পাঠ্যবইয়ে আছে।’

ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন: ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবই থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে দুটি লেখা ‘সন অব দ্যা সয়েল’ ও ‘মুজিব ইন স্কুল ডেজ’ বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, কবিতা ‘দ্য ম্যাজিক ই’ও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

এই বইয়ে বিজয় দিবসের ওপর নতুন গদ্য ‘আওয়ার প্রাইড’ এবং পদ্য ‘দ্য ক্যাওস’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সপ্তম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবই থেকে ‘বঙ্গবন্ধুস লাভ ফর স্পোর্টস’ ও ‘বন্ধুবন্ধুস রেসপন্স টু ন্যাচারাল ক্যালামিটিস’ শিরোনামের দুটি লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে।

একই বই থেকে শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জীবনীভিত্তিক ‘বঙ্গমাতা: আওয়ার সোর্স অব ইন্সপিরেশন’ লেখাটি বাদ দেওয়া হবে এবং ছাত্র আন্দোলনের ওপর দুটি লেখা ‘অ্যা নিউ জেনারেশন’ ও আওয়ার উইনারস ইন গ্লোবাল এরিনা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবই থেকে ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শিরোনামে লেখাটিও বাদ দেওয়া হবে এবং ‘ওমেনস রোল ইন দ্যা আপরাইজিং’ ও ‘হিউম্যান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

নবম শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবই থেকে ‘ফাদার অব দ্যা নেশন’ লেখাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ছাত্র আন্দোলনে গ্রাফিতির ওপর একটি লেখা এবং ‘সেন্স অব সেলফ’ ও ‘লনলিনেস’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাংলা পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন: পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই থেকে শামসুর রাহমানের কবিতা ‘রৌদ্র লেখে জয়’, লুৎফর রহমান রিটনের ছড়া ‘ফেব্রুয়ারির গান’ ও সেলিনা হোসেনের ছোটগল্প ‘অপেক্ষা’ বাদ দেওয়া হয়েছে।

নরসিংদীর ওয়ারি-বটেশ্বর নিদর্শন নিয়ে লেখা ‘মাটির নিচে শহর’, নায়াগ্রা জলপ্রপাত নিয়ে লেখা ‘দেখে এলাম নায়াগ্রা’, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও ব্রিটিশ ভারতে বিপ্লবী তিতুমীর সম্পর্কিত বিষয়বস্তুও এই বই থেকে বাদ গেছে।

তবে নতুনভাবে বইটিতে জুলাই আন্দোলন নিয়ে লেখা ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’, কবিতা ‘সবার আমি ছাত্র’ এবং ‘জলপরি ও কাঠুরের গল্প’, ‘নোলক’, ‘কুমড়ো ও পাখির কথা’, ‘দৈত্য ও জেলে’সহ বেশ কয়েকটি লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠ বইয়ে কামরুল হাসানের ‘আমাদের চারুকলা’ এবং জুলাই আন্দোলনের ওপর একটি লেখা যোগ করা হয়েছে।

এই বইয়ে রোকনুজ্জামান খানের ‘মুজিব’ কবিতার স্থলে তারই লেখা ‘চিঠি বিলি’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

বাংলা ব্যাকরণ বই থেকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সরানো হয়েছে, যেখানে তাকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ ও মুক্তিযুদ্ধের একক নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

সপ্তম শ্রেণির সপ্তবর্ণা বই থেকে সেলিনা হোসেনের প্রবন্ধ ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ বাদ দেওয়া হবে এবং হাছান রোবায়েতের লেখা ‘সিঁথি’ যুক্ত করা হবে। এ ছাড়া, গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ এবং সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতা দুটি বাদ দেওয়া হবে।

সপ্তম শ্রেণির আনন্দপাঠ বই থেকে সেলিনা হোসেনের ভ্রমণকাহিনী ‘সুইজারল্যান্ডের দিনগুলো’ সরানো হবে।

অষ্টম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরি’ ও ‘গণআন্দোলনের গল্প’ শিরোনামে দুটি গদ্য যুক্ত করা হবে এবং কামরুল হাসানের ‘আমাদের চারুকলা’ লেখাটি সরানো হয়েছে। একই শ্রেণির একটি অন্য বাংলা বই থেকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমড়া ও ক্র্যাব নেবুলা’ উপন্যাসটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ে জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’ ও জুলাই আন্দোলনের ওপর লেখা সংকলন ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’, মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরি’, কবির চৌধুরীর ‘পহেলা বৈশাখ’, জহির রায়হানের ‘বাঁধ’, সেলিনা হোসেনের ‘রক্তে ভেজা একুশ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘নিয়তি’ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘তথ্য প্রযুক্তি’।

এ ছাড়া, কাজী নজরুল ইসলামের ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’, নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ ও কামাল চৌধুরীর ‘সাহসী জননী আমার’ কবিতাগুলোও বাদ দেওয়া হয়েছে। এই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’ উপন্যাসটি যোগ করা হবে এবং সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ বাদ দেওয়া হয়েছে।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘অনেক লেখকের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, একই বিষয়ে বিকল্প বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন: সেলিনা হোসেন ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লেখা সরানো হলেও একই বিষয়ে অন্যান্য লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’

এনসিটিবি কর্মকর্তা ও পাঠ্যবই পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ এমন একটি নীতি গ্রহণ করেছে, যেখানে ঐতিহাসিক প্রমাণ ছাড়া কোনো অতিরঞ্জিত তথ্য পাঠ্যবইয়ে রাখা হবে না।

একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, কোনো ঘটনা বা ব্যক্তিকে অযথা প্রাধান্য দেওয়া হবে না এবং কোনো ঘটনা বা ব্যক্তির অবদান কম গুরুত্ব পাবে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যবইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ বলা হয়নি।

রিয়াজুল হাসান বলেন, জাতির পিতা” শব্দটি সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটি আর প্রাসঙ্গিক নয়। আমাদের ‘প্রতিষ্ঠাতা নেতা’ শব্দটি ব্যবহার করা উচিত। একজনকে জাতির পিতা বলা হলে এটি একজন নেতার একক গল্প হয়ে যায়।

পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত লেখক ও গবেষক রাখাল রাহা বলেন, পাঠ্যবই থেকে বঙ্গবন্ধুকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়নি।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অষ্টম শ্রেণির একটি বইয়ে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের একটি বইয়ে তার ভাষণের ইংরেজি সংস্করণও রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির একটি বইয়েও শেখ মুজিব সম্পর্কে লেখা রয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, দেশের ইতিহাসে অবদান রাখা নেতাদের মধ্যে পাঠ্যবইয়ে তাকে (শেখ মুজিব) নিয়ে রচনা অনেক বেশি-ই রাখা হয়েছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.