প্রশাসনের সহযোগিতায় আশ্রয়ণের বাসিন্দারা স্বাবলম্বী
মোছা. নাসিমা বেগম। ২০১৪ সালে ভ্যান চালক রফিকুল ইমলামের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। ২০১৭ সালে গর্ভে সন্তান আসার কিছুদিন পরই এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান রফিকুল ইমলাম। এরপর থেকেই মা ও সন্তানকে নিয়ে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের বাড়ি কাজ করে চলছিলো নাসিমার সংসার।
মুজিববর্ষে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে নাসিমা একটি ঘর বরাদ্দ পান। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া আর্থিক সহযোগিতায় তিনি শুরু করেন চায়ের দোকান। এখন প্রতিদিন এই দোকান থেকে নাসিমার আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আর এ টাকা দিয়েই ছেলে ও মাকে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন তিনি। শুধু নাসিমা বেগমই নন, তার মতো গোপাপুরের ঝাওয়াইল গ্রামের মডেল আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৭টি পরিবার প্রশাসনের সহায়তায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৩ হাজার ২০৬টি ভূমিহীন, গৃহহীন পরিবার চিহ্নিত করা হয়। এদের মধ্যে ২ হাজার ৯৯৩টি পরিবারকে বাড়ি দেওয়া হয়েছে। এ জেলায় অবৈধ দখলে থাকা ১৫০ বিঘা খাস জমি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জমিতে আশ্রয় প্রকল্পের বাড়ি নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের স্বাবলম্বী করতে ভ্যান গাড়ি, সেলাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকা ব্যক্তিদের স্ব স্ব কাজ নিশ্চিত করা হয়েছে।
গোপালপুর উপজেলার ১৮৪ জন ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে মুজিববর্ষের বাড়ি প্রদান করা হয়েছে। গত বছর ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা করেছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঝাওয়াইল আশ্রয়ণ প্রকল্পে পাশাপাশি দুই জায়গায় ৩৩টি পরিবার বসবাস করছেন। সবাই একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করছেন।
নাসিমা বেগম বলেন, ‘জন্মের পর বাবার অভাবের সংসারে কষ্টে বড় হয়েছি। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে শান্তিতে বসবাস করলেও তার মৃত্যুতে আমার জীবনে আবার অন্ধকার নেমে আসে। দুই তিন দিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে। দোকানের আয়ে এখন আমার সংসার ভালোই চলছে। বর্তমানে আমি আমার বাড়িতে শান্তিতেই আছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে জমিসহ পাকা দালান পাওয়া নিজের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। এই চায়ের দোকান না থাকলে আমার ছেলে ও মাকে নিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। এখন পর্যন্ত কখনো উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে খালি হাতে ফিরে আসিনি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ তার উদ্যোগের কারণে আমার মতো আশ্রয়হীন মানুষের মাথা গোঁজার ঠিকানা হয়েছে। এছাড়াও ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের খাদ্য সামগ্রী, টাকা, জামা কাপড় দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
ভ্যান পাওয়া মন্টু চন্দ্র রায় বলেন, ‘আগে শ্রমিকের কাজ করতাম। একদিন কাজ করলে আরেক দিন বসে থাকতে হতো। নিয়মিত কাজ না হওয়ায় ঘর পাওয়ার পরও খুব কষ্টে চলতে হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ভ্যান পাওয়ার পর প্রতিদিন ভ্যান চালাই। যা আয় হয়, তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়েদেয়ে শান্তিতেই আছি।’
মন্টু রায়ের স্ত্রী সুমিতা চন্দ্র রায় বলেন, ‘ঝাওয়াইল বাজারের রাস্তার পাশে একটি ছাউনি ঘরে প্রায় ২০ বছর কাটিয়েছি। সেখানে ঝড়, বৃষ্টি ছাড়াও ছাউনি ভেঙে পড়ার ভয়ে কোনো দিন শান্তিতে রাতে ঘুমাতে পারিনি। এখন আমার আপন ঠিকানায় সন্ধ্যার পরই শান্তিতে ঘুমাতে পারি। এছাড়াও আগে সন্তান নতুন জামা কাপড় চাইলে অভাবের সংসারে তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারিনি। এখন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দয়ায় জমিসহ বাড়ি ও ভ্যান পেয়ে সবার চাহিদা পূরণ করে শান্তিতেই আছি।’
আশ্রয়ণের অপর বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে দোকান ভাড়া নিয়ে মুরগির ব্যবসার করতাম। সে সময় তেমন বিক্রি হতো না। উপজেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ভ্যান পাওয়ার পর বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মুরগি বিক্রি করতে পারছি। এতে আমার বিক্রি বেশি হওয়ায় লাভ বেশি হচ্ছে। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে আমরা বেশি স্বাবলম্বী হচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে আশ্রয়ণে আসতে আমাদের অনেক কষ্ট হতো। নতুন জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করে নতুন পাকা রাস্তা করে দিয়েছেন। ফলে আমাদের যাতায়াতে অনেক উপকার হয়েছে।’
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক বলেন, ‘মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় উপহার হলো ভূমি ও গৃহহীনদের বাড়ি দেওয়া। প্রত্যেককে দুই শতাংশ জমিসহ ১৮৪ জনের মধ্যে বাড়ি বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া আশ্রয়ণে বসবাসকারীদের সাবলম্বী করে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সহায়তাও দিয়েছেন। পূর্নবাসন করার পরও অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনায় নারী পুরুষ অনেককে সরকারি জমিতে দোকান করে দেওয়া, অনেককে ভ্যান দেওয়া হয়েছে। এরপরও যারা রাজমিস্ত্রিসহ বিভিন্ন পেশার কাজ জানতো তাদের আমরা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিচ্ছি।’
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া কর্মসূচির আওতায় আমরা টাঙ্গাইলেও প্রায় তিন হাজার পরিবারের মধ্যে জমিসহ বাড়ি হস্তান্তর করেছি। এখন ওইসব বাড়িতে যারা থাকছেন তাদের স্বাবলম্বী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সব সদস্যদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে নতুন কাপড় খাদ্য সহায়তা দিয়ে তাদের পাশে প্রশাসন সর্বদা রয়েছে।’