প্রতিবন্ধী মহুয়া ৩৫ নারীকে স্বাবলম্বী করেছেন

জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী বগুড়ার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া। এ কারণে খুব ছোটবেলা থেকেই কষ্ট আর দুর্ভোগের মধ্যে জীবনের চাকা ঘুরছে তার। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও মানসিকভাবে তিনি স্বপ্ন দেখেন আকাশ ছোঁয়ার। সেই স্বপ্নকেই একটু একটু করে বাস্তবে রূপ দিচ্ছেন কাপড়ে সুই-সুতার কারুকাজ করে।

গত চার বছর আগে একা নারীদের পোশাকে সেলাইয়ের কাজ শুরু করে মহুয়া আজ সফল উদ্যোক্তা। এই কাজের মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাননি, আরও ৩৫ নারীকেও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করেছেন। মহুয়া স্বপ্ন দেখছেন ঘরের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে একটি কারখানা স্থাপনের, যেন প্রতিবন্ধী এবং অসহায় নারীরা স্বাবলম্বী হতে পারেন।

মহুয়ার বাড়ি বগুড়া শহরের চকলোকমান এলাকার খন্দকার পাড়ায়। তার বাবা আব্দুল মজিদ ছিলেন ব্যাংকের কর্মকর্তা। মা ছাহেরা বেগম গৃহিণী। তারা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই গোলাম মোস্তফা ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির লেকচারার এবং মেজ ভাই মোহাম্মাদ আলী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিবন্ধী হয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বেঁচে থাকা পর্যন্ত তার চিকিৎসা করিয়ে গেছেন। তার বাবা সবসময় চেয়েছেন তাকে স্বাভাবিক রাখতে, পড়াশোনা করাতে। তার মাও তাকে সব ধরনের যত্ন নিয়ে বড় করেছেন। স্কুল কলেজে পড়ার সময় তার মা তাকে হুইলচেয়ার ঠেলে প্রতিদিন নিয়ে যেতেন, নিয়ে আসতেন।

ঘুম থেকে উঠার পর আবারও ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত তার মা-ই ভরসা। ২০১২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গোল্ডেন ‘এ প্লাস’ পান। এরপর বগুড়া শাহ সুলতান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ইংরেজি সাহিত্যে আজিজুল হক কলেজ থেকে অনার্স শেষ করে এখন মাস্টার্সে অধ্যায়ন করছেন।

২০১৬ সালে অনার্স প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে তিনি নিজের হাতখরচ চালানোর জন্য অফলাইনে (লোকাল এরিয়া) থ্রি-পিসে সেলাইয়ের ফোড় তুলতে শুরু করেন। এরপর ২০১৭ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইনে শুরু করেন নিজের হাতের কাজ করা শাড়ি থ্রি-পিস বিক্রি। সে সময় তিনি একা হলেও বর্তমানে তার সঙ্গে আরও ৩৫ জন নারী কাজ করছেন। এই নারীদের তিনি নিজেই কাজ শিখিয়েছেন। কাজ শেখার পর তারা কাজ নিয়ে বাড়িতে বসে সেলাই করেন। কোনো সমস্যা হলে আবারও মহুয়ার কাছে গিয়ে দেখে নেন।

এছাড়া তিনি আরও নারীদের কাজ শেখাচ্ছেন, যাতে তারাও স্বাবলম্বী হতে পারেন। তার সঙ্গে কাজ করা একজন নারী একটি থ্রি-পিস সেলাই করে মজুরি পান ৩৫০-৪০০ টাকা, শাড়িতে কাজ করে পান ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা। কাজ করা এসব থ্রি-পিস মহুয়া ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন ১৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা এবং শাড়ি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি করেন।

প্রতি মাসে তার ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মতো শাড়ি, থ্রিপিস বিক্রি হয়। তবে উৎসব এলে তার বিক্রি লাখ টাকা ডিঙিয়ে যায়। ২০১৭ সাল থেকেই তিনি হাতের কাজ করা শাড়ি, থ্রি-পিস মূলত বিক্রি করেন ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকে তার ‘Rainbow রংধনু’ নামে একটি পেজ আছে। এই পেজে গেলেই তার পণ্যের ছবি ও বিস্তারিত পাওয়া যাবে। এছাড়া ফেসবুকের ‘উই’ গ্রুপের সঙ্গেও মহুয়া যুক্ত আছেন। ‘উই’ গ্রুপের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরও ১৭টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশি এবং সেখানকার স্থানীয়দের কাছে পণ্য বিক্রি করেছেন। গত এক বছরে ৭ লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন মহুয়া উই গ্রুপের মাধ্যমে।

প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করার স্বপ্ন নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছেন মহুয়া। যে কারণে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও চার বছর আগেই ব্যবসায় নেমে পড়েন তিনি। তিনি সাধ্য অনুযায়ী টাকা জমাতে শুরু করেছেন। তিনি চান প্রতিবন্ধীদের জন্য এমন একটা সংস্থা করতে, যে সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরা কিছু অনুদান পাবেন এবং তাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারবেন।

মহুয়া মনে করেন, অধিকাংশ প্রতিবন্ধীর পরিবার তাদের লেখাপড়া করাতে চায় না। প্রতিবন্ধীরা যদি লেখাপড়া করে শিক্ষিত হন, তাহলে তাদের আর কেউ অবহেলার চোখে দেখবে না। তারাও কাজ করতে পারবেন। এখন তো বিশ্বায়নের যুগ। এখন ঘরে বসেও অনলাইনে কাজ করা যায়। তাই তিনি এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন।

মহুয়ার হয়ে কাজ করছেন শেরপুরের রোজিনা আক্তার, সোহাগী এবং আখি জানান, মহুয়ার সঙ্গে কাজ করতে পেরে তারা খুশি। কারণ মহুয়া খুব শান্ত এবং খুব ভালো করে শিখিয়ে দেন। মহুয়ার কারণে তারা বাড়িতে বসে অর্থ উপার্জন করতে পারছেন।

মহুয়া বলেন, ‘আমার মা ছাড়া আমাকে দেখাশোনার কেউ নেই। সকালে ঘুম থেকে জাগার পর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মাকে ছাড়া কোনো কিছু কল্পনা করতে পারি না। তবে মায়ের বয়স হয়েছে। মা আর কতদিন এভাবে আমাকে দেখবেন। এই বিষয়টি আমার খুব খারাপ লাগে। তবে হতাশা এখন খুব একটা কাজ করে না। কারণ আমার পরিবারের সবাই আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমার যত্ন নিতে সবাই খুব উদগ্রীব।’

মহুয়া আরও বলেন, ‘২০১৬ সালে প্রাইভেট পড়িয়ে এবং অফলাইনে ব্যবসা করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেই টাকা দিয়ে একটি স্মার্টফোন কিনি। স্মার্টফোন কেনা আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। কারণ ফোনের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার আরও সহজ হয়। ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে মেয়েদের কাপড়ের বিজনেস দেখি। তখন নারীদের জন্য পোশাকে সেলাইয়ের কাজ করে বিক্রির বিজনেসটা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়।’

‘প্রথম দিকে ওড়না, থ্রি-পিস, শাড়ি দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। এখন ওয়ান পিস, বিভিন্ন শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশন কভার, সোফার কভারসহ আরও অনেক পণ্য নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া আগে শুধু সুতি কাপড়ে কাজ করতাম। এখন পণ্যের গুণগত মানের কথা মাথায় রেখে কাপড়ের বৈচিত্র নিয়ে এসেছি। কুমিল্লার খাদি, রাজশাহীর মসলিন, সিল্কসহ মোটামুটি সব ধরনের পণ্য রয়েছে।’

মহুয়া জানান, তার নিজের বাড়ি বগুড়া শহরে হলেও তিনি বর্তমানে শেরপুরের ছোনকা বাজার এলাকায় ভাড়া বাসাতে মাকে নিয়ে থাকেন। সেখানকার নারীদের দিয়েই তিনি শাড়ি, থ্রি-পিসে সেলাইয়ের কাজ করান। ভবিষ্যতে ছোনকা বাজারেই কারখানা দেওয়ার ইচ্ছে আছে তার। ঢাকাতে একটি শো-রুম দিতে চান তিনি।

মহুয়ার মা জানান, মেয়ে প্রতিবন্ধী। কষ্টে তার বুক ফেটে যায়। অনেক চিকিৎসা করানোর পর তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন মেয়ে অনলাইনে ব্যবসা করছে। উপার্জন করছে। নিজের জীবনযাপনের খরচ নিজে উঠাচ্ছে পাশাপাশি অন্য অসহায় নারীদেরও উপার্জনের ব্যবস্থা করছে, এই একটি কারণ থেকে তিনি শত কষ্টের মাঝেও খুশি। তিনি সব রকম পরিস্থিতিতে তার মেয়ের সঙ্গে আছেন বলে জানান এবং সবার কাছে তার মেয়ের জন্য দোয়া চান।

বগুড়ার আঁচল বুটিক অ্যান্ড ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী উম্মে ফাতেমা লিসা বলেন, ‘মহুয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় বগুড়ার ‘উই’ গ্রুপের এক মিটআপে। আগে শুনেছিলাম প্রতিবন্ধী এক নারী ভালো এক উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। তখন সরাসরি তাকে আমি দেখিনি। ভেবেছিলাম সাদামাটা কোনো প্রতিবন্ধী নারী। কিন্তু মিটআপে তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর পুরোটাই ‘থ’ খেয়ে গেছি। কারণ সে চলাফেরা করতে পারে না। একটা ঠোট নাড়াতে পারে না। হাত দুটোও বাকা। কিন্তু সে সফল একজন উদ্যোক্তা। সে যেভাবে কাজ করছে, আমরা সুস্থ-সবল নারীরাও সেভাবে করতে পারি না। সত্যি এটা প্রশংসার দাবিদার।’

রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তহমিনা পারভীন শ্যামলী বলেন, ‘যেখানে আমাদের সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের কাজ করতে কত রকমের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সেখানে তাকে আরও কত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, এটা আমাদের ভাবতে হবে। তারপরেও সে পেছনে না হেঁটে মনোবলের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তার কাজ দেখে আমি অনুপ্রেরণা পাই কাজ করার। মহুয়া যদি এমন করে সফল হতে পারেন, তাহলে একজন সুস্থ-সবল মানুষের যদি ইচ্ছা শক্তি থাকে, তাহলে সে কেন পারবে না?’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.