নিষিদ্ধের পরও ব্যবহার থামছে না পলিব্যাগের

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিব্যাগের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করলেও কাঁচাবাজার, মুদি দোকান ও রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকানগুলোয় পলিব্যাগের ব্যবহারে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আসেনি। মহল্লার কাঁচাবাজারে পলিব্যাগের ব্যবহার বেশি।

এদিকে,বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ পাটের ব্যাগ ব্যবহারে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে, লালবাগ, শহীদ নগর ও চকবাজারের সরু গলির পাশের কারখানাগুলো বছরের পর বছর ধরে পলিব্যাগ উৎপাদন করে আসছে। সরকারের ভাষ্য, বিকল্পের অভাবকে দায়ী করে পলিব্যাগ ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

পরিবেশবিদদের মতে, উপযুক্ত বিকল্প পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকায় ২০০২ সালে পলিথিন নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়ন হোঁচট খায়। সুতরাং, পলিথিন সমস্যা সমাধানে সহজলভ্য ও কম দামের বিকল্প ব্যাগ উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে সুপারমার্কেটগুলো: স্বপ্ন, আগোরা, ইউনিমার্ট ও মীনা বাজারসহ প্রধান সুপারমার্কেটগুলো নতুন নিয়মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। সেসব সুপারস্টোরে এখন পাট ও কাগজের ব্যাগ পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদেরকে তাদের ব্যাগ আবার ব্যবহারে উত্সাহিত করছে। পোস্টার-ফেস্টুনের মাধ্যমে ক্রেতাদের পলিব্যাগ ব্যবহার কমানোর গুরুত্বের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, যারা পুরোনো ব্যাগ সঙ্গে আনতে ভুলে যান, তাদেরকে এই স্টোরগুলো ২০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ দেয়।

পলিব্যাগ বাদ দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী সুপারশপ ‘স্বপ্ন’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বলেন, ‘আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। গ্রাহকদের পলিথিনের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করছি।’

তবে উদ্বেগের বড় কারণ হলো গ্রাহকদের আচরণ ও তাদের কেনাকাটার অভ্যাস। আগে বিনামূল্যে পলি ব্যাগ পাওয়া যেত বলে এখন অনেক ক্রেতা ২০-২২ টাকা দিয়ে পুনঃব্যবহারযোগ্য পাটের ব্যাগ কিনতে আগ্রহী নন। মাছ-মাংসের মতো ভেজা পণ্য বহনে পাটের ব্যাগ ঝামেলার হতে পারে।

সাব্বির হাসান নাসির মনে করেন, ‘ক্রেতাদের জন্য আরও কম দামে ভালোমানের টেকসই পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরিতে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া উচিত।’

পাটের ব্যাগের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা তুলে ধরে নাসির বলেন, ‘বর্তমানে স্বপ্নের আউটলেটগুলোয় প্রতিদিন প্রায় এক লাখ ব্যাগ দরকার হয়। আউটলেটের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই চাহিদা মাসে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে।’

বাংলাদেশ জুট ডাইভারসিফায়েড প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইউটিএ) সভাপতি রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, ‘হঠাৎ করে কম দামে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তা মেটাতে পাটশিল্প প্রস্তুত নয়।  এ ধরনের ব্যাগ উৎপাদনে আলাদা উপকরণ ও বিনিয়োগের প্রয়োজন। এই নিষেধাজ্ঞা অন্তত তিন বছরের জন্য কার্যকর রাখতে গেজেট দরকার।  এটি বিনিয়োগকে উত্সাহিত করবে। এই শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।’

পাটের ব্যাগ ব্যবসায়ী ও ক্রেতা উভয়ের জন্য সহজলভ্য করতে সুপারমার্কেটে পণ্য বিক্রির ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) তুলে নেওয়ার পরামর্শও দেন রাশেদুল করিম মুন্না। তিনি মনে করেন, পাটের ব্যাগ উৎপাদনে আর্থিক প্রণোদনা ও সহায়ক অবকাঠামোর অভাব পলিব্যাগ নিষেধাজ্ঞার দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

আগোরা লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার খন্দকার নূর-ই-বুরহান বলেন, ‘প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর পরিবেশগত সুবিধা সম্পর্কে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন। অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে পুনঃব্যবহারযোগ্য ব্যাগ দিয়ে কেনাকাটার প্রবণতা এখনো নতুনদের মধ্যে গড়ে উঠেনি।’

গ্রাহকরা প্রায়ই পুনঃব্যবহারযোগ্য ব্যাগ কিনতে দ্বিধায় থাকেন। মান ও আকারের ওপর নির্ভর করে এর দাম হয় ১৫ থেকে ২৫ টাকা। ‘অতিরিক্ত খরচের পাশাপাশি বারবার বাজারে ব্যাগ নিয়ে যাওয়াকে অনেক ক্রেতা বিরক্তিকর মনে করেন। একবার ব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব ব্যাগের দাম পাঁচ-সাত টাকার মধ্যে হলে ভালো হয়।’

কম দামের ও ভালোমানের পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বাজারে কম বলে স্বীকার করেন তিনি। এ ছাড়া, কাঁচা বাজারে পলিব্যাগের ব্যবহার অব্যাহত থাকায় সুপারমার্কেটগুলোর জন্য তা সমস্যা তৈরি করছে। এই বৈষম্য ব্যবসার মুনাফায় প্রভাব ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে তার মত, সরকারের উচিত সব ব্যবসার জন্য সমান নীতি নিশ্চিত করা।

উৎপাদন খরচ কমাতে ও ক্রেতাদের জন্য এসব বিকল্প আরও কম দামে সরবরাহ করতে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ প্রস্তুতকারকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি।

কাঁচাবাজারে পলিব্যাগ নিষিদ্ধের চ্যালেঞ্জ: মুদি দোকানদার ও ক্রেতারা জানান, খুব কম মানুষই নিজেদের ব্যাগ নিয়ে বাজারে আসেন। পণ্য বহনের জন্য তারা পলিব্যাগ দিতে দোকানিদের বাধ্য করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সবজি বিক্রেতা বলেন, ‘বাজারে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ পাওয়া যায়। সেগুলোর অনেক দাম। মানুষ কিনতে চান না। দোকানদাররা একমত সরকার পলিব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সত্ত্বেও এর কোনো বিকল্প দিতে পারেনি।

মালিবাগ বাজারে আসা ক্রেতা আসাদ রহমান মাছ-সবজি কিনে সবকিছু আলাদা পলিব্যাগ নেন। এরপর সেগুলো বড় ব্যাগে রাখেন। বাজার থেকে বের হওয়ার সময় তার হাতে ছিল আটটি পলিব্যাগ। তিনি বলেন, ‘পলিব্যাগ ছাড়া মাছ-মাংস ফ্রিজে রাখবো কীভাবে? বাজার থেকে ভেজা পণ্য আনার জন্য কি বিকল্প ভালো কিছু আছে?’

কিন্তু পলিব্যাগ কম ব্যবহার করতে পারেন কিনা—এমন প্রশ্নে জবাবে আসাদ বলেন, ‘প্লাস্টিক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সুবিধা অনেক। তাই নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ কার্যকর করার আগে সরকারকে অবশ্যই বিকল্প দিতে হবে।’

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ মনে করেন, পরিবেশবান্ধব ব্যাগের অভাব থাকায় পলিব্যাগের বিকল্প নেই। তবে পলিব্যাগের সম্ভাব্য বিকল্প বাজারে আনার জন্য মন্ত্রণালয়ের গবেষণা বিভাগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কাপড় ও পাটের ব্যাগ দিয়ে এটা পূরণ করা যেতে পারে।’

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.