নিউইয়র্ক টাইমসে পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিক: বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারি

বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও শিশুদারিদ্র্যের হার স্তম্ভিত করার মতো। দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ১ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ গত বুধবার দেশটির আইনসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে, সেখানে শিশুদারিদ্র্য নিরসনে পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিক ও কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ।

‘ইউএস পোভার্টি অ্যান্ড এ লুক টু বাংলাদেশ’ শিরোনামে ১২ মার্চ পত্রিকাটিতে প্রকাশিত নিবন্ধে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ত্রাণ প্যাকেজ নিয়ে তিনি লিখেছেন, এই প্যাকেজে এমন কিছু বিধান রাখা হয়েছে যার কারণে দ্রুত শিশুদারিদ্র্য হ্রাস পাওয়া উচিত। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের করা একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রণোদনা প্যাকেজে নেওয়া এসব পদক্ষেপ যদি স্থায়ীরূপ পায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের শিশু-দারিদ্র্য অর্ধেকে নেমে আসবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ঐতিহাসিক এই পদক্ষেপ কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট যা করেছিলেন এটা হবে তার সঙ্গে তুলনীয়।

বাইডেন প্রশাসনের নেওয়া এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এর মাধ্যমে এটা তুলে ধরা হয়েছে যে, দরিদ্র শিশুদের জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের বিনিয়োগ করার এক ধরনের দায় রয়েছে। আর এর মাধ্যমে যে ফল পাওয়া যাবে তা বোঝার জন্য বাংলাদেশের উদাহরণ টেনেছেন তিনি।

স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন নিকোলাস ক্রিস্টফ। তিনি বলেছেন, ৫০ বছর আগে এই মার্চেই গণহত্যা, বিবাদ আর অনাহারের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের, যে দেশটিকে হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো দেশটির হতাশাব্যঞ্জক বর্ণনা তুলে ধরেছিল বিশ্বে।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। সেসময় খবর সংগ্রহ করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন নিকোলাস ক্রিস্টফ। তখন নিউইয়র্ক টাইমসে এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, বাংলাদেশ দুর্ভাগা একটি দেশ। তবে তার সেই হতাশা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় যারপরনাই আনন্দ প্রকাশ করেছেন নিকোলাস ক্রিস্টফ। সদ্য প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয়, বাংলাদেশ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে থাকায় আমি তখন ঠিকই বলেছিলাম। কিন্তু আমার অনুমান ভুল প্রমাণিত করে গত তিন দশকে দেশটি অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে।

নিকোলাস ক্রিস্টফ লিখেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলমান মহামারির আগের চার বছর ধরে দেশটির অর্থনীতি প্রতি বছরে ৭ থেকে ৮ শতাংশ বেড়েছে, যা চীনের চেয়েও দ্রুততর।

বর্তমানে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২ বছর। ক্রিস্টফ লিখেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি জায়গার চেয়ে বেশি, মিসিসিপির ১০টি কাউন্টির চেয়েও। এক সময় হতাশার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠলেও কীভাবে উন্নতি করতে হয় তার শিক্ষা দিতে বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই আদর্শ। আর এই উন্নতির গোপন রহস্য হলো– শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি।

তিনি বলেছেন, ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশেরও কম শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারত না। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। দেশটির অর্থনীতিতে নারীদের অবদান তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। সেসময় সরকার ও নাগরিক সংগঠনগুলো শিক্ষার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করে, বিশেষ করে মেয়েদের। আজ বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোচ্ছে। নারী-পুরুষ বৈষম্য থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে–বাংলাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি।

বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা উল্লেখ করে নিকোলাস ক্রিস্টফ লিখেছেন, ড. ইউনূস তাকে বলেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা হচ্ছে, নারীর অবস্থান পরিবর্তন। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দরিদ্র নারীদের জীবনমানের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে।

নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে গত চার বছরে প্রায় এক লাখ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এটা তাদের যেমন স্বাবলম্বী করেছে, তেমনি দেশের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে ক্রিস্টফ লিখেছেন, বাংলাদেশ মেয়েদের শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত করেছে। এখন এরাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হয়ে উঠেছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প নারীদের কর্মসংস্থানের বড় জায়গা সৃষ্টি করেছে। এদের কল্যাণেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প চীনের পর আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম।

এই শিল্পের বিভিন্ন সমস্যার কথাও উল্লেখ করেছেন ক্রিস্টফ। তিনি লিখেছেন, এই শিল্পে স্বল্প মজুরি থেকে শুরু করে অগ্নিকাণ্ড, যৌন হেনস্তার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। এছাড়াও রয়েছে আগুনের ঝুঁকি ও অন্যান্য নিরাপত্তা সমস্যা। ২০১৩ সালে দেশটির এক তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১ হাজার ১০০ এর বেশি পোশাক শ্রমিকের প্রাণহানি হয়। কিন্তু এরপরেও এসব পোশাক শ্রমিকই আবার বলেছেন, ১৪ বছর বয়সে বিয়ে কিংবা ফসলের ক্ষেতে কাজ করার চেয়ে এ ধরনের চাকরি অনেক ভালো। দেশটির শ্রমিক ইউনিয়নগুলো এবং নাগরিক সমাজ শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে চাপ দিয়ে আসছে। এতে অনেকটা কাজও হয়েছে।

ক্রিস্টফ লিখেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষিত নারীরা এখন গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উচ্চপদে কাজ করছেন।শিশুদের টিকা দিচ্ছেন নারীরা। মানুষকে টয়লেট ব্যবহারে সচেতন করে তোলার কাজটিও করছেন তারা। একইসঙ্গে তারা গ্রামের নিরক্ষর মানুষকে পড়তে শিখিয়েছেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি বোঝাচ্ছেন। বাল্যবিয়েকে নিরুৎসাহিত করার কাজও করছেন।

বাংলাদেশে বড় মাপের কোনো রাজনৈতিক নেতা পায়নি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, তারপরও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ সমাজে যে গতিধারা সৃষ্টি করেছে, আমরা সবাই সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ‘দারিদ্র্য বিমোচনের অনুপ্রেরণার আখ্যান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। গত ১৫ বছরে আড়াই কোটি বাংলাদেশি দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছেন। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা এখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও কম।

জনসংখ্যার অতি ঘনত্ব এই উন্নয়ন রুদ্ধ করে দেবে বলে যারা মনে করেন, তাদের উদ্দেশে ক্রিস্টফ লিখেছেন, বাংলাদেশের নারীরা এখন গড়ে দুটি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন।

তিনি লিখেছেন, অল্প কথায় বলতে গেলে, বাংলাদেশ তার সবচেয়ে অবহেলিত সম্পদ অর্থাৎ তার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর বিনিয়োগ করেছে, মনযোগ দিয়েছে সবচেয়ে প্রান্তিক ও সবচেয়ে কম উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী ওপর। আর এ কারণেই এখান থেকে সবচেয়ে বেশি ফল পেয়েছে। আমেরিকার ক্ষেত্রেও এটি সত্য। আমরা আমাদের শতকোটিপতিদের আরও বেশি উৎপাদনশীলতার জন্য চাপ দিতে পারি না, কিন্তু আমরা যদি আমেরিকার প্রতি সাত শিশুর মধ্যে একজনের ঝরে পড়া আটকাতে পারি তাহলে দেশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে।

ক্রিস্টফ মনে করেন, শিশু-দারিদ্র্য নির্মূলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নেওয়া আগ্রাসী পদক্ষেপ হয়তো সেটা করে দেখাতে পারে। বাংলাদেশ আমাদের এটা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, প্রান্তিক শিশুদের ওপর বিনিয়োগ শুধু করুণ বা সমবেদনার বিষয় নয়, এটা একটা জাতিকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শিশুদারিদ্র্য হ্রাসে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ক্রিস্টফ লিখেছেন, ফেরতযোগ্য শিশু কর ঋণ স্থায়ী করা উচিত। তার মতে, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা নিছক সহানুভূতির ব্যাপার নয়, জাতির উন্নতিতে তার দরকার আছে।

You might also like

Leave A Reply

Your email address will not be published.