দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে উন্নত দেশুগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পার্থক্য জবাবদিহিতায়
বাংলাদেশে জেনারেল প্র্যাকটিসনারদের অনেকটা অবহেলা বা অবজ্ঞার চোখে দেখা হলেও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে তা অনেক সাধনা, চেষ্টা কিংবা আকাঙ্ক্ষার বিষয়। তাই দেশের জেনারেল প্র্যাকটিসনারদের যথাযথ এডুকেশন দিতে হবে, রেগুলেশন তৈরি করতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে অবকাঠামোগত সুবিধা থাকলেও সিস্টেমে সমস্যা রয়েছে।
৩১ জানুয়ারি রাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জেনারেল প্র্যাকটিসকে কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা যেতে পারে?’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব মতামত ব্যক্ত করেন।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের সদস্য এবং পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. তৌফিক জোয়ার্দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আলোচক অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করা তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকঃ
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান ডা. রুমানা সবুর, কানাডার অন্টারিও থেকে জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা. জিয়া উর রহমান এবং যুক্তরাজ্য থেকে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) ডা. ফাতেমা হেলেন সালাম।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক এই জনগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ডা. রুমানা বলেন, প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান হলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মেরুদণ্ড।
ডা. জিয়া কানাডায় নিজের কাজের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে জানান, কলেজ অফ ফিজিশিয়ান অফ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানস স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে এবং কলেজ অফ ফিজিশিয়ান অফ সার্জন অফ ইন্ডিভিজুয়াল প্রভিন্স তা নিশ্চিত করে জেনারেল প্র্যাকটিসনারদের (জিপি) কাজের অনুমতি বা লাইস্যান্স দেয়। প্রতিবছরই আবার সেই লাইসেন্স নবায়ন করতে হয় ২৫ ঘণ্টার ট্রেনিং এর বিনিময়ে। এভাবে জিপি সবসময় ‘আপ টু ডেট’ থাকার কারণে রোগীরাও তাদের উপর আস্থা পান। আর জিপি যদি মনে করেন তাহলে তিনি রোগীকে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পাঠান।
যে রোগের চিকিৎসা করা জেনারেল প্র্যাকটিসনারদের দ্বারা সম্ভব নয় অথবা যা তার অধ্যয়ন সংশ্লিষ্ট নয়, সে রোগীর চিকিৎসা করা ওই চিকিৎসকের অপরাধ বলে মনে করেন ডা. জিয়া। তার মতে, রোগী কখন কোন বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন সে নির্দেশনা দেয়াও জিপির দায়িত্ব।
ডা. ফাতেমা যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন নামকরা হাসপাতালগুলোয় নিজের কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, সেখানে আট ঘন্টা কাজের অর্থ দশ ঘন্টা কাজ করা। পান থেকে চুন খসলেও জবাবদিহি করতে হয়। যুক্তরাজ্যে প্রত্যেকেরই একটি এনএইচএস নাম্বার রয়েছে এবং প্রত্যেককেই জিপির সাথে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়। ওই ব্যক্তি যেখানেই যান না কেনো এনএইচএস দ্বারা তার মেডিক্যাল রেকর্ড অনলাইনে পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্যে জিপিদের জন্য রয়েছে রয়েল কলেজ অফ জিপি। জিপি হবার জন্য পরীক্ষা নেয়া হয় খুবই কঠোরভাবে।
ডা. রুমানা বলেন, বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড় পার্থক্য সেখানে একটি ‘হেলথ ডেলিভারি সিস্টেম’ রয়েছে। এই সিস্টেম একটি প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে যার মাধ্যমে একজন মানুষকে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা ও তাকে সুস্থ রাখা, তার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ব্যবহার করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত ফল এ তিনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এই সিস্টেম সুপ্রতিষ্ঠিত। সরকারি বেসরকারি সবাইকে সমানভাবে মনিটরিং এর পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়৷ কোন চিকিৎসকেরই জবাবদিহিতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সুবিধার কথা উল্লেখ করে দেশে রেফারেল সিস্টেম চালুর উপর জোর দিয়ে ডা. জিয়া জানান, কানাডায় অধিকাংশ রোগীর স্বাস্থ্যসেবা জিপি-ই নিশ্চিত করে। জিপি অনেকটা মা’র ভূমিকা পালন করে। জিপি-র কাছে রোগীর বিস্তারিত রেকর্ড থাকে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে যুক্তরাজ্যের অনেক ক্ষেত্রেই পার্থক্য রয়েছে জানিয়ে ডা. ফাতেমা বলেন, এনএইচএস ১৯৪৮ সালে চালু হয়েছে। সুতরাং তাদের আজকের এই সুশৃঙ্খল অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র। তাই অনেকের রোগ একই হলেও তাদেরকে ভিন্ন ভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। প্রত্যেক রোগীকেই যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। প্রয়োজনে রোগীর সামনেই তাকে ঔষধ প্রদানের জন্য মেডিকেলের বই খোলা হয়। ঔষধ নিয়মিত রিভিউ করা হয়। রোগীকে হাসিমুখে বিদায় করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়।