দগ্ধ রোগীর চাপ বার্ন ইনস্টিটিউটে, ৬০ শতাংশই নারী-শিশু
রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এখন অসংখ্য রোগী দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এবার শীতকালে পোড়া ও অগ্নিদুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি।
একটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছয় বছর বয়সী শিশু আয়েশা আক্তার (ছদ্মনাম)। তার শরীরের শতকরা ৪৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। আয়েশা রাজধানীর পূর্বাচলের কাঞ্চন ব্রিজ এলাকার বাসিন্দা। দগ্ধ হওয়ার পর গত ৩ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশুটিকে।
আয়েশার মা সায়মা বলেন, বছরের শুরুতে শীতটা বেশি ছিল। দুপুরে চুলায় ভাত রান্না করছিলাম। এমন সময় আয়েশা আগুন পোহাতে চুলার পাশে বসে। চুলার আগুন তার জামায় লেগে যায়। এতে পা থেকে কোমর পর্যন্ত পুড়ে যায় তার। হাতের কয়েক জায়গাও আগুনে ঝলসে যায়।
হাসপাতালে কর্মরত নার্সরা জানান, সারা বছরই রোগীর চাপ থাকে। তবে শীতকালে তা বৃদ্ধি পায়। শীতকালে ঘরোয়াভাবে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে। শীতকালে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে গরম পানি দিয়ে গোসল করা হয়। কিংবা বাইরে আগুন জ্বলিয়ে অনেকেই উষ্ণতা নিতে চান। আর এটি করতে গিয়ে আগুন লেগে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। আর এসব দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুরা।
জরুরি বিভাগের আরেকটি বিছানায় শুয়ে থাকা দুই বছর আট মাস বয়সী শিশু নূর মোহাম্মদের অবস্থাও অনেক খারাপ। খিলক্ষেত এলাকায় গরম পানিতে মারাত্মক দগ্ধ হয় শিশুটি।
তার বাবা শাহ আলম বলেন, আমার মা গোসলের জন্য গরম পানি নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় আমার ছেলে হঠাৎ দৌড়ে এসে ধাক্কা দিলে সেই পানি তার শরীরে পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি।
বার্ন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোট ১৪ হাজার ৪০২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার ৩৫০। শীত মৌসুমে, বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ রোগী হাসপাতালে এসেছেন। যারা জটিলতা অনুযায়ী বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। শীতে দুর্ঘটনা বাড়ায় গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আর এদের মধ্যে ৬০ শতাংশই নারী ও শিশু।
রোগীর চাপে বার্ন ইনস্টিটিউটের ২০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং ৫৭ শয্যার হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) প্রায় সবসময় পূর্ণ থাকে। শীতের সময় সে চাপ আরও বেড়েছে।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) সরজমিনে দেখা যায়, বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগ পোড়া রোগীতে পরিপূর্ণ। একই অবস্থা অন্তঃবিভাগের অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোতেও। তাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে আছে হাসপাতালের পরিবেশ। জরুরি বিভাগের বেশিরভাগ রোগী গরম পানি কিংবা আগুনে পুড়ে হাসপাতালে এসেছেন। যাদের একটা বড় অংশ রাজধানীর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন।
বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের মতো বহির্বিভাগেও রোগীদের ব্যাপক চাপ লক্ষ্য করা গেছে। সকাল থেকেই চিকিৎসক দেখানোর জন্য রোগীদের ভিড় লেগে থাকে বহির্বিভাগে। বহির্বিভাগে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ড্রেসিংসহ অন্যান্য সেবা দেওয়া হয়। অনেকে আন্তঃবিভাগ থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসার জন্য বার্ন ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে আসেন।
যা বলছেন সেবা সংশ্লিষ্টরা: হাসপাতালে কর্মরত নার্সরা জানান, সারা বছরই রোগীর চাপ থাকে। তবে শীতকালে তা বৃদ্ধি পায়। শীতকালে ঘরোয়াভাবে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে। শীতকালে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে গরম পানি দিয়ে গোসল করা হয়। কিংবা বাইরে আগুন জ্বলিয়ে অনেকেই উষ্ণতা নিতে চান। আর এটি করতে গিয়ে আগুন লেগে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। আর এসব দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি পড়ে শিশুরা।
বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, দেশে প্রথমত ইলেকট্রিক বার্ন অর্থাৎ বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হন বেশি। দ্বিতীয়ত, স্ক্যাল্ড বার্ন তথা গরম পানি, গরম তেল বা গরম কোনো তরল পদার্থে পুড়ে, যেটি শীতকালে বেশি ঘটে। তৃতীয়ত, ফ্লেম বার্ন তথা সরাসরি আগুনের সংস্পর্শে পুড়ে থাকে। মোমবাতি, কেরোসিন বাতি, চুলা বা অন্যভাবে শাড়ি, ওড়না, জামা-পায়জামা বা পরিধেয় বস্ত্রে আগুন লাগা থেকে এ ঘটনা ঘটে। চতুর্থত, কেমিক্যাল বার্ন তথা দাহ্য পদার্থ জাতীয় রাসায়নিকে পুড়ে থাকেন।
ডা. শাওন বলেন, এবার গরম পানি, গরম তেলে পোড়া রোগী বাড়ছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আগুন থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি আগুনে দগ্ধ হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।