তেল নিয়ে তেলেসমাতি, দাম বাড়ানোই ছিল লক্ষ্য!
ধারণা ছিল দাম বাড়বে, সবাই ভেবেছে, ‘দুদিন রেখে দিলে লাভ হবে’, যে কারণে সংকট বেড়েছে
আবার ভোজ্যতেল নিয়ে তেলেসমাতির দেখা মিলল। বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ তলানিতে নামার বাড়ল দাম; এরপর দোকানেও মিলতে শুরু করল। টানা কয়েকদিন ধরে ছোট-বড় সব বাজার থেকে তেল উধাও হওয়ার মধ্যে সোমবার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সরকারের তরফে বলা হয়েছে,আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে।
সরবরাহ সংকটের কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলেছেন, পরিবেশকদের কাছ থেকে পণ্য না পাওয়ার কথা। পরিবেশকরা দায় দিয়েছেন বড় কোম্পানিগুলোকে। তবে কোম্পানির দাবি, তাদের দিক থেকে সংকট ছিল না। সব পক্ষ যখন বুঝেছে দাম বাড়বে, তখন তারা মজুদ করেছে।
মাসখানেক ধরেই সয়াবিন তেলের সংকট রাজধানীর বাজারে। সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বাজার থেকে একেবারে উধাও ১, ২ ও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল। ফলে বেশ কয়েকদিন ধরেই ক্রেতারা ভুগেছেন। তেল কিনতে দোকান থেকে দোকানে ঘুরতে হয়েছে, বোতল পাওয়া গেলেও বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে কেনা যায়নি, কারণ, বোতলের গায়ে থাকা সর্বোচ্চ মূল্যের ঘোষণা তুলে ফেলে বাড়তি টাকা দাবি করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক শেষে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন তেল বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর সমিতি বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার।
লিটার প্রতি ৮ টাকা বেড়ে এখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা ঠিক হয়েছে ১৭৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ও খোলা পাম তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে ১৫৭ টাকা; পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া যাবে ৮৫২ টাকায়।
কেন দাম বেড়েছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গত এপ্রিলে দাম যখন ১৬৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, তারপর থেকে বিশ্ববাজারে দাম ‘অনেকটাই’ বেড়েছে। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে এখন একটি ‘যৌক্তিক’ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর সমস্যা হবে না।
ভোজ্যতেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতি টন তেলের দাম ১২০০ ডলারে উঠেছে। গত এপ্রিলে সরকার যখন তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তখন প্রতি টনের দাম ছিল ১০৩৫ ডলার। এখন আমরা ১১০০ ডলার ধরে লিটারে ৮ টাকা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়তে থাকার পর গত ১৮ অক্টোবর ভোজ্য তেলের আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ৫ শতাংশ কমানোর পাশাপাশি উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার করে সরকার।
এরপর নভেম্বরে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরও ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে শুধু আমদানিতে ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। এরপরেও কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে বলে, নইলে তাদের লোকসান হচ্ছে।
মোস্তফা হায়দার বলেন, এক্স বন্ড, ইন বন্ড ভ্যালু এবং গত এক মাসে যে এলসি খোলা হয়েছে, তার ভ্যালু- এই তিনটা ভেল্যু যোগ ও গড় করে একটা দাম ঠিক করতে হয়। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ খরচ, বোতলজাতকরণ খরচ যোগ করতে হয়। ২০১১ সাল থেকে এই পদ্ধতি চর্চা হয়ে আসছে।
শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) তথ্যানুযায়ী, গেল চার মাস ধরেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১১০০ ডলারের আশপাশে ছিল।
এখন থেকে মাসে মাসে সরকারের সঙ্গে বসে তেলের দাম ঠিক করা হবে বলেও জানান বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।
আমদানি বেড়েছে : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১০৬ টনের কিছু বেশি, যা আগের বছরের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪ হাজার ১৭ টন বেশি।
এই সময়ে পরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি করা হয়েছে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭৭৬ টনের কিছু বেশি, অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি করা হয়েছে ৩ হাজার ৯৯৯ মেট্রিক টনের কিছু বেশি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, সব রকম তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি দেশে যে মজুদ রয়েছে- সন্তোষজনক; মজুদে কোনো ঘাটতি নেই। অন্যদিকে ছোট ছোট জায়গা থেকে শুরু করে সব জায়গায় এক ধরনের মজুদদারি তৎপরতা আমরা দেখতে পেয়েছি।
মজুদদারির তৎপরতার বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার কাজ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টি চিন্তা করেছে।